বৈষ্ণোদেবী
বৈষ্ণোদেবী : শাস্ত্রীয় প্রমাণ ও ইতিহাসের পর্যালোচনা
"গোভির্জুষ্টময়ুজো নিষিক্তন্তবেন্দ্র বিষ্ণোরনুসঞ্চরেম ।
নাকস্য পৃষ্ঠমভি সংবসানো বৈষ্ণবীং লোক ইহ মাদয়ন্তাম্ ॥"
দুর্গা সূক্ত, তৈত্তিরীয়ারণ্যকম্ ৪, প্রপাঠকঃ ১০, অনুবাকঃ ২
শাক্তধর্মের বিখ্যাত তীর্থস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম হল জম্মুর ত্রিকূট পর্বতে অবস্থিত "বৈষ্ণোদেবী" তীর্থ । এই তীর্থকে কেন্দ্র করে বর্তমানে বহু ভ্রান্ত ধারণা লক্ষ্য করা যায় যার মূলে রয়েছে এক বিরাট ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। এই প্রসঙ্গে আজ এই লেখার অবতারণা।
[[ ভীডা দেবী : বৈষ্ণোদেবীর শাস্ত্রীয় রূপ]]
নামকরণ :-
[[ বৈষ্ণোদেবী মন্দির]]
"বৈষ্ণোদেবী" নামটি একটি তদ্ভব হিন্দি শব্দ যা সরাসরি সংস্কৃত নয় বরং সংস্কৃত থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। মূল শব্দটি হল বৈষ্ণবী । "বৈষ্ণবী" শব্দের অর্থ নিয়েও ভ্রান্ত ধারণা আছে । অনেকে বৈষ্ণবী মানে বিষ্ণুসাধিকা আবার অনেকে বিষ্ণুর পত্নী ভাবেন । আসুন দেখি শাস্ত্র কি বলছে । দুর্গা সপ্তশতী তে মহালক্ষ্মী মহিষমর্দিনী কে নারায়ণী বা বৈষ্ণবী বলা হয়েছে কারণ উনি বিষ্ণুর অন্তঃস্থ শক্তি।- "ত্বং বৈষ্ণবী শক্তিরনন্তবীৰ্যা বিশ্বস্য বীজং পরমায়সি মায়া ।"- শ্রীশ্রীচণ্ডী
দেবী পার্বতী প্রতিটি জীবের মধ্যে শক্তিরূপে অবস্থান করেন (কিন্তু তাতে তিনি সকলের পত্নী হয়ে যান না, কারণ উনি স্ত্রীলোকদের মধ্যেও শক্তি রূপেই বিরাজমান)। অনুরূপভাবে বরাহ পুরাণের ত্রিকলা মাহাত্ম্যও বলছে, "শঙ্খচক্রধরাদেবী বৈষ্ণবী সা কলা স্মৃতা । সা পাতি সকলং বিশ্বং বিষ্ণুমায়েতি কীর্ত্যতে॥" বিষ্ণুর অন্তঃস্থ গিরিনন্দিনীর কলা কেই বৈষ্ণবী বলা হয়। কামধেনু তন্ত্র বলছে "ক্ষেমঙ্করী বৈষ্ণবী চ বিষ্ণুমাতা শিবার্চিতা" । একইসঙ্গে ওই তন্ত্রের অষ্টম পটল বর্ণ মাতৃকাদের কালিকার রূপ বলেছে । সুতরাং বৈষ্ণবী অর্থ বিষ্ণুর অন্তঃস্থ শক্তি কিংবা বিষ্ণু জননী । বরাহ পুরাণের ত্রিকলা মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে মানব কল্পে শতশৃঙ্গ পর্বতে ( যা জম্মু থেকে ৭২ মাইল দূরে অবস্থিত) দেবী বিংশভূজা বৈষ্ণবী মহিষাসুর কে বধ করছিলেন। বৈষ্ণোদেবীর লোককথায় ও জানা যায় দেবী মহিষ বধের পর এই গুহায় আশ্রয় নেন ।
শাস্ত্রে উল্লেখ :-
[[ বৈষ্ণোদেবীর তিন পিণ্ড]]
ত্রিকূট পর্বতের এই শাক্ত তীর্থের উল্লেখ বহু শাস্ত্রেই পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনকৃত দুর্গাস্তোত্র। সেখানে বলা হয়েছে," জম্বূকটকচৈত্যেষু নিত্যম্ সন্নিহিতালয়ে ॥ " এখানে দেবীর জম্বূ পর্বতে বাস করার কথা রয়েছে। তারই সঙ্গে বলেছে, "গোপেন্দ্রস্যানুজে জ্যেষ্টে নন্দগোপকুলোদ্ভবে ॥" দেবী বিষ্ণু জননী যোগমায়া পরে কৃষ্ণের ভগিনী হয়ে জন্ম নিচ্ছেন , এটি তারই বিবরণ।
এছাড়াও দেবী ভাগবত মহাপুরাণে জাম্বুনদেশ্বরী / জম্বাদিনী র উল্লেখ আছে। সম্ভবতঃ তিনিই বৈষ্ণোদেবী। তাঁর মন্দার পর্বতমালায় জম্বু নামক নদীর তটে বাস করার কথা রয়েছে । মার্কণ্ডেয় পুরাণে ভারতের উত্তর দিকে জম্বু্ জনপদের কথা আছে যা থেকেই জম্মু নামটি এসেছে। দেবী গীতায় বলা হয়েছে, "জাম্বুনদেশ্বরীস্থানং তথা শ্রীনগরং পরম্"।
সঙ্গম সাহিত্যের আচারক্কোবাই সংকলনেও কিঞ্চিত আভাস আছে । বৈষ্ণোদেবীর ব্যাপারে যে কাহিনীটি আছে যে উনি দক্ষিণ ভারতের রত্নাকর সাগর রাজার কন্যা হয়ে জন্ম নেন । এই কাহিনীটি কিছুটা বিবর্তিত হয়ে এসেছে মীনাক্ষী মাহাত্ম্য থেকে । আচারক্কোবাই অনুসারে দেবী মীনাক্ষী কৈলাস এ গমন করেছিলেন শতশৃঙ্গ পর্বত এর পাশ দিয়ে যা কাটরার প্রায় নিকটেই অবস্থিত । তিনি মাঝে একটি নদীতে নিজের কেশ ধৌত করেন ( যা বৈষ্ণোদেবীর বাণগঙ্গার ন্যায় তুলনীয়)। এই স্থানে তিনি শিবের সাথে সাক্ষাৎ পান ও বিবাহের প্রতিশ্রুতি ও লাভ করেন।
বৈষ্ণোদেবী কার স্বরূপ ?:-
বৈষ্ণোদেবী কে নিয়ে একটি প্রবল বিতর্ক বিদ্যমান যে তিনি কার স্বরূপ । বহু ব্যক্তি তথাকথিত লৌকিক গল্পের দোহাই দিয়ে বলেন যে তিনি ভবিষ্যতে কল্কিদেব (ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার) কে বিবাহ করবেন। রামচন্দ্র নাকি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন । কিন্তু বাস্তবে তা যুক্তিসম্মত নয় । কারণ কল্কিপুরাণ বলছে কল্কিদেব রমা ও পদ্মা কে বিবাহ করবেন । তাছাড়া মহাভারতের মতে যোগমায়া বৈষ্ণবী বিষ্ণুর ভগিনী রূপে উল্লেখিত। পূর্বে উল্লেখিত ভীড়া মহাবিদ্যা র স্বামী হিসেবে রুদ্রযামল তন্ত্রের দেবীরহস্য গ্রন্থটি বিরূপাক্ষ শিব এর কথা বলছে । অধুনা, দেবীর তিনটি পিন্ডিকে (ব্রহ্মশিলা) দুর্গা সপ্তশতীর মহাকালী, মহালক্ষ্মী (চণ্ডিকা) ও মহাসরস্বতী (কৌশিকী) রূপে পুজো করা হয়। বিভিন্ন যামল তন্ত্রের মতে ওই তিনটি পিন্ড দেবী বালা,দেবী সুন্দরী ও দেবী ভৈরবীর প্রতীক যেখানে বালিকাসুন্দরী সত্ত্বগুণ, ত্রিপুরসুন্দরী রজোগুণ ও ভৈরবী তমোগুণের পরিচায়ক । অর্থাৎ ললিতা রূপা বৈষ্ণবী ত্রিগুণাতীতা ।
[[ শিব গুফা ]]
বৈষ্ণোদেবীর গুহার অনতিদূরে একটি গুহা বিদ্যমান যেখানে শিব লিঙ্গ আছে । সেটি শিবগুফা নামে পরিচিত। কথিত আছে, দেবী সতী যেখানেই থাকবেন, সেখানেই ভগবান শিব লিঙ্গরূপে অবস্থান করবেন । ত্রিক কাশ্মীরি পন্ডিতদের মধ্যে বিখ্যাত বি.এন. পন্ডিত তাঁর বৈষ্ণবী দেবী রহস্য গ্রন্থে এই শিব গুহার উল্লেখ করে প্রমাণ করেছেন দেবী স্বচ্ছন্দভৈরবের পত্নী। কারণ মাতৃকাদের অষ্টভৈরব স্বচ্ছন্দভৈরবেরই প্রকাশ। শুধু তাইই নয়, তিনি বৈষ্ণোদেবী গুহায় ত্রিপিন্ডির সামনে শিবের পিন্ডির ও উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে কোন প্রাণীকে সৃজনে সক্ষম বা ব্রহ্মা বানাতে পরমেশ্বর যে নারীরূপে প্রকাশিত হন, তিনিই ব্রাহ্মী । অনুরূপে বৈষ্ণবী শক্তির মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ ভৈরব অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডকে পালনের জন্য অনন্ত বিষ্ণুর সৃষ্টি করেন। স্বচ্ছন্দ তন্ত্রে বলা হয়েছে, বৈষ্ণবী শক্তি যেসব প্রাণীদের মধ্যে প্রবেশ করে, তাঁরাই বিষ্ণু নামে পরিচিত হন। স্বচ্ছন্দনাথের স্ত্রী স্বরূপ হলেন সিদ্ধিলক্ষ্মী (সিদ্ধেশ্বর শিবের পত্নী)।ত্রিদশ ডামর, দূতী ডামর, হরচরিতচিন্তামণি -র মতে এই সিদ্ধিলক্ষ্মী মহাশিবরাত্রির দিন কৈলাসপতি পরমশিব এর হৃদয় হতে আবির্ভূতা হন। ব্রহ্মপুরাণ বলছে, সিদ্ধিলক্ষ্মীর থেকেই ব্রাহ্মী, বৈষ্ণবী ও রৌদ্রী র প্রকাশ । এর সঙ্গে দেবী ত্রিকলা-র তত্ত্বগতভাবে মিল লক্ষ্য করা যায় (যদিও মূর্তিরূপ পৃথক)। আবার সুন্দরীস্তব মতে, "ব্রাহ্মী রৌদ্রী বৈষ্ণবীতি শক্তিস্ত্রিয় এবহি। পুরং শরীরং যস্যা সা ত্রিপুরেতি প্রকীর্তিতা॥" - ব্রাহ্মী,রৌদ্রী ও বৈষ্ণবী মিলে যাঁর শরীর গঠন করে, তিনিই ত্রিপুরা নামে খ্যাতা।
[[বৈষ্ণবী শতশৃঙ্গনিবাসিনী]]
এছাড়াও বরাহ পুরাণের মতে, বৈষ্ণবী শতশৃঙ্গনিবাসিনী মহিষমর্দিনী। এই শতশৃঙ্গ পর্বত গীতাপ্রেসের মতে কাটরার কাছেই অবস্থিত । বরাহ পুরাণ বলছে, "সুররাক্ষসা: পঞ্চকূটে দানবা: শতশৃঙ্গে দানবযক্ষাণাং পুর:শতম্ । তস্যৈবোত্তরপার্শ্বে ত্রিকূটং নাম যত্র ব্রহ্মা তিষ্ঠতি ॥"
অর্থাৎ শতশৃঙ্গ পর্বতের নিকটেই ত্রিকূট পর্বত অবস্থিত। ত্রিদেবের তেজ থেকে উৎপন্ন দেবী ত্রিকলা নিজেকে তিন ভাগে বা কলায় বিভাজিত করেন । তাঁরা হলেন ব্রাহ্মী, বৈষ্ণবী ও রৌদ্রী । এরা দুর্গা সপ্তশতীর ত্রিশক্তির মতোই তিনজনেই পার্বতীর ই প্রত্যক্ষ রূপ। ব্রাহ্মী হলেন ব্রহ্মদেবের কন্যা গৌরী, যিনি দক্ষের আলয়ে জন্ম নেন । তিনি বেত্রাসুরকে বধ করে বিন্ধ্যবাসিনী, নন্দা দেবী ইত্যাদি নামে পরিচিতা হন। মহিষমর্দিনী বৈষ্ণবী চণ্ডরূপা, চণ্ডিকা, বিষ্ণুমায়া নামে খ্যাতা হন । রৌদ্রী কালরাত্রি ও চামুণ্ডা নামে পরিচিতা। এই ব্যাপারে বরাহ পুরাণ বলে,
এতাসাং সর্বভেদেষু পৃথগেকৈকশো ধব়ে ।
সর্বাসাং ভগবান্ রুদ্রঃ সর্বগ্গশ্চ পতির্ভবেৎ ॥
যাবন্ত্যস্যা মহাশক্ত্যাস্তাবদ্ব়ূপাণি শঙ্করঃ।
কৃত্তিবাসাশ্চ ভজতে পতিরূপেণ সর্বদা ॥
অর্থ :- ভগবান রুদ্রদেব, এই দেবীদের স্বামী এবং সর্ব প্রকার শক্তিতে সমভাবে অবস্থিত। ফলতঃ শক্তির সংখ্যা যত পরিমানে ব্যবস্থিত, রুদ্রমূর্তির পরিমাণও তর। কৃত্তিবাস পতি রূপে ঐ সকল শক্তিকেই ভজনা করিতেছেন এবং তিনি যখন যে সময় করেন, তৎক্ষণাৎ তাহা সিদ্ধ হয়।
এই কাহিনীকে কেন্দ্র করে বহু ভাষ্য ও টীকা পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ অপ্পয়দীক্ষিত বিরচিত দুর্গাচন্দ্রকলাস্তুতি তেও বৈষ্ণবী দেবীর উল্লেখ বিদ্যমান।
"মাহিষ্মতীতনুভবং চ রুরুং চ হন্তুং আবিষ্কৃতৈর্নিজরসাদবতারভেদৈঃ ।অষ্টাদশাহতনবাহতকোটিসঙ্খ্যৈঃ অম্বা সদা সমভিরক্ষতু মাং বিপদ্ভ্যঃ ॥ ৯॥
এতচ্চরিত্রমখিলং লিখিতং হি যস্যাঃ সম্পূজিতং সদন এব নিবেশিতং বা। দুর্গং চ তারয়তি দুস্তরমপ্যশেষং শ্রেয়ঃ প্রয়চ্ছতি চ সর্বমুমাং ভজেতাম্ ॥ ১০॥
যৎপূজনস্তুতিনমস্কৃতিভির্ভবন্তি প্রীতাঃ পিতামহ রমেশহরাস্ত্রয়োঽপি ।তেষামপি স্বকগুণৈর্দদতীং বপূংষি তামীশ্বরস্য তরুণীং শরণং প্রপদ্যে ॥ ১১॥"
এই স্তোত্রের ভাষ্যে শিবপ্রিয়া বৈষ্ণবী কিভাবে শতশৃঙ্গ পর্বতে সিন্ধুদ্বীপাত্মজ মহিষাসুর কে বধ করলেন তার কথা বলা হয়েছে। "অষ্টাদশাহতনবাহতকোটিসঙ্খ্যৈঃ" অর্থাৎ দেবী বৈষ্ণবী অষ্টাদশ কোটি সংখ্যক যোগিনী তে পরিবৃতা । যা বরাহপুরাণেও বলা হয়েছে। দেবী তার পূর্বে পিতামহ ব্রহ্মদেবের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মীরূপে সরোবর থেকে উৎপন্ন হন । তাই পিতামহকৃত দেবীর স্তোত্র পাঠে পিতামহ বিরিঞ্চি ও তুষ্ট হন।
[[ শিব গুফা বোর্ড ]]
তদুক্তং শৈবাগমে কাশীকল্পে-:
সরোবরসমুৎপন্নে বিধিনুতে ভোেগমোক্ষপ্রদে শিবে। চৈত্রনিসূদিনি নমস্তেহস্তু পরাগায়ত্রি তে নমঃ নমস্তে॥
শরৎসোমশুভ্রে নমস্তে বিন্ধ্যবাসিনি। মন্মথারিপতিব্রতে নমস্তেস্তু শিবায়ৈ সততং নমঃ॥
নমস্তে তত্ত্বরূপিণি বিভবায়ামিতাত্মিকে ।মহিষনির্নাশিনি নমোহস্তু শতশৃঙ্গকৃতাশ্রয়ে॥
নমঃ তাপহারিণ্যৈ নমস্তে শোণোৎপলাভে। অন্ধকারিকুটুম্বিনি নমস্তেস্ত শিবায়ৈ সততং নমঃ॥
নমস্তেহস্তু ভদ্রকালি ভেদপ্রভিন্নৈরভিন্নযুগ্রে। রুরুভঞ্জিনি নমোহস্তু নীলোৎপলদলাঙ্গি নমঃ॥
নমস্তে ঘোররূপিণি নমস্তে মুণ্ডমর্দিনি। ত্রিপুরমথনভামিনি নমস্তেস্ত শিবায়ৈ সততং নমঃ॥
নমো নমস্তে বিশালাক্ষি ত্বামহং শরণং গতঃ। বিশ্বেশ্বরস্য ভার্যাসি বিশালাক্ষি নমোেনমঃ॥
শক্তিপীঠ:-
পূর্বে বলা হয়েছে দেবী গীতার ৬৪ টি পীঠের মধ্যে এর অবস্থানের কথা । তবুও অনেকে এই তীর্থকে স্থানীয় / লোক সাংস্কৃতিক তীর্থ বলেন । তাঁদের মতে এটি কোনো শক্তিপীঠ নয়। তবে বৈষ্ণোদেবী ট্রাস্ট এর মতে এখানে সতীর পাণিকমল পতিত হয়েছে। প্রতিমা বিজ্ঞান গ্রন্থে গন্ধর্বলে যোগমায়া শক্তিপীঠের উল্লেখ আছে।
সর্বোপরি কাঞ্চী কামকোটী পীঠের শ্রী বিদ্যা সাধক গুহানন্দ নাথের নিপাতিন সংহিতা গ্রন্থের ৫০০টি শক্তিপীঠের তালিকায় এর উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে,
" কাশ্মীরনিলয়াদেবী সর্বপীঠব্যবস্থিতা । ভীডাদেবীতি সমাখ্যাতা ত্রিকূটাচল গিরৌস্মৃতা॥"
কাশ্মীরের ত্রিকূটাচলে ভীডা দেবী বাস করেন। এই ভীডা দেবীর সম্পর্কে লেখা আগমোদ্যোত তন্ত্র, রুদ্রযামল তন্ত্র ও বহু আগমে পাওয়া যায়। রাজ্ঞী, বালা, সুন্দরী প্রমুখ দেবীদের মত বহু কাশ্মীরি হিন্দবংশের কুলদেবী হলেন ভীডা। তন্ত্রভেদে তাঁর মূর্তিতত্ত্ব পরিবর্তিত হয়। রুদ্রযামল তন্ত্র বলছে, "ভীডায়াস্তু বিরূপাক্ষঃ শিবঃ" অর্থাৎ দেবীর পতি বিরূপাক্ষ শিব । ত্রিক পরম্পরায় দেবীর বহুল পূজা হত।
কামরূপে যেমন কামাখ্যা মন্দির কে কেন্দ্র করে উপশক্তিপীঠ আছে( দশমহাবিদ্যা মন্দির), বারাণসীতে বিশালাক্ষী কে কেন্দ্র করে নবগৌরী, নবদুর্গা আদি উপশক্তিপীঠ আছে, তেমনি বৈষ্ণোদেবী বা ভীড়া শক্তিপীঠ কে কেন্দ্র করে উপশক্তিপীঠ আছে। অর্ধকুমারী, বানগঙ্গা, নবদুর্গা গুহা, চরণপাদুকা প্রভৃতি । হয়তো পূর্বে সেখানে দেবীর অন্যান্য রূপের পুজো হয় , শতশৃঙ্গনিবাসিনী বৈষ্ণবীও হয়তো এদের মধ্যেই কেউ একজন। বৈষ্ণোদেবীর সঙ্গে ভৈরোনাথের যুদ্ধ মধ্যযুগের শক্তিবিদ্বেষী সম্প্রদায়ের সঙ্গে শাক্ত দের সংগ্রামের উদাহরণ।
প্রাচীন কাশ্মীরি সাহিত্যে উল্লেখ:-
প্রাচীন কাশ্মীরি কোশুর ভাষার বইয়েও এই সতীপীঠের উল্লেখ পাওয়া যায়। উদাহরণ:-
গরু তরফন চ্যং দিতথখ বাগুরাংবিথ॥"
কোশুর সাহিত্যে জম্মুর ত্রিকূট পর্বতে শিব ও শক্তির নিবাসের কথা বলা হয়েছে।
বৈষ্ণদেবী ষড়যন্ত্র:-
[[ বৈষ্ণবদের অপপ্রচারের চিত্র ]]
এবার আসি ইতিহাসের কথায়। কিভাবে একটি শাক্ত তীর্থ তথা সতীপীঠ বৈষ্ণবকেন্দ্রে পরিণত হল । একাদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে নিম্বকাচার্য নামক একজন বৈষ্ণবের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর সম্প্রদায় পরে নিম্বকাচার্য সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় যার সঙ্গে মৌলবাদের তুলনা করলে ভুল বলা হয় না (বৈষ্ণবদের কোনোভাবেই নিন্দা করা হয়নি, যারা বৈষ্ণব পরিচয় দিয়ে অপকর্ম করে তাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে)। তা হচ্ছে অন্য সম্প্রদায়ের পীঠস্থান কে বৈষ্ণবতীর্থে পরিণত করা । এই পরম্পরার একজন তথাকথিত বৈষ্ণব গুরু শ্রী হরিব্যাস দেবাচার্য কাশ্মীরে গিয়ে ত্রিক পরম্পরার উপর আঘাত হানেন । তৎকালীন সময়ে দুর্গম কাশ্মীর পার্বত্য অঞ্চলে শাক্ত দের সংখ্যা খুবই কম ছিল সেখানে যাওয়া সেই নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী বৈষ্ণব সম্প্রদায়টির থেকে। তাই সেই তথাকথিত সম্প্রদায় অতি সহজেই শাক্ত ও শৈবদের নিপীড়ন করে, তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে বৈষ্ণব কার্যকলাপ চালু করেছিল । তাঁদের আগ্রাসনে সেখানে শাক্তদের প্রথা ( যেমন বলি, যন্ত্রপূজা, তান্ত্রিক প্রক্রিয়া) বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে সেখানে যাওয়া সাধারণ তীর্থযাত্রীদের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দেওয়াই ছিল এই মৌলবাদী বৈষ্ণবদের উদ্দেশ্য। তাই তারা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে থাকে যে হরিব্যাস দেবাচার্য চটথবল অঞ্চলে চণ্ডিকাকে দীক্ষা দিয়েছেন। অতিব হাস্যকর ব্যাপার এই যে মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী একানংশা দেবীকে এক তুচ্ছ সাধারণ মানুষ দীক্ষা দিতে পারে ? কিন্তু সাধারণ মানুষ যে সহজ সরল । তাই তাদের মগজধোলাই করা খুবই সহজ। তাই চটথবল থেকে ত্রিকূট পর্বত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের আগ্রাসন চলে।
এইভাবে একটি শাক্ত তীর্থস্থান মৌলবাদী তথাকথিত বৈষ্ণব ( প্রকৃতপক্ষে ভণ্ড ) সম্প্রদায়ের উপনিবেশে পরিণত হয় ।
পুনরুত্থান:-
১৮৪৬ সালে মহারাজা গুলাব সিং এখানে ধর্মনাথ ট্রাস্ট গঠন করেন । এর ফলে এখানে একটি নির্দিষ্ট পূজার্চনা শুরু হয়। করণ সিং এর নেতৃত্বে ধর্মনাথ ট্রাস্ট এর থেকে পৃথকভাবে বৈষ্ণোদেবী মন্দির ট্রাস আত্মপ্রকাশ করে। ট্রাস্টের কার্যকলাপ অনুযায়ী এখানে প্রতিদিন নবার্ণ সপ্তশতী (শ্রীশ্রীচণ্ডী) মতে দেবীর পুজো হয় । অগ্নিদুর্গার ধ্যানে দেবী প্রপূজিতা , তবে মূর্তি হিসেবে পরাম্বিকা দুর্গা প্রচলিত । এখানে প্রতিদিন দুর্গা সপ্তশতী, অষ্টোত্তর শতনাম পাঠ হয়। বছরের দুই নবরাত্রিতে এখানে উৎসব হয় প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে । তখন দশমহাবিদ্যা, নবদুর্গা র ও পুজো হয় । দেবীর নিকটে শিব গুহায় বিরূপাক্ষ শিবের পুজো হয় । এছাড়া কাছাকাছি ভৈরোনাথ, অর্ধকুমারী, চরণপাদুকা ইত্যাদি মন্দিরেও পুজো হয়। ধীরে ধীরে এখানে সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবীয় প্রভাব মুছে যাচ্ছে এবং তদুক্ত নিম্বকাচার্য সম্প্রদায়ের চিহ্ন এখানে এখন নেই বললেই চলে।
Thanks everyone
ReplyDelete