কাশ্মীর পরম্পরায় মহাত্রিপুরসুন্দরী
কাশ্মীর পরম্পরায় মহাত্রিপুরসুন্দরী
~মূল লেখায়- রোহন
অনুবাদে - অয়ন্তিক বসু
ত্রিপুরসুন্দরী দেবী আদিপরাশক্তি র একটি অতিঅত্যন্ত সুন্দর ও সৌম্য রূপ । তিনি ত্রিক পরম্পরার প্রধান দেবী যাঁকে প্রায়শই শ্রীবিদ্যা নামে অভিহিত করা হয় কারণ এটি তাঁর মূলমন্ত্রের ও নাম। যদিও শ্রীবিদ্যা শব্দটি এই দেবীর প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতে খুব বেশি পাওয়া যায় না তবে আজকের যুগে ভারতে প্রচলিত দেবীর পরম্পরা সাধারণতঃ শ্রীবিদ্যা পরম্পরা নামে পরিচিত । তবে এই পরম্পরাকে ত্রৈপুর দর্শন বা ত্রৈপুর পরম্পরা ( Doctrine or Tradition of Tripurā) বলাই বেশি যুক্তিসঙ্গত । আমরা এখানে এই শব্দটিই ব্যবহার করব ।
এই পরম্পরাকে সৌভাগ্য পরম্পরা বা সৌভাগ্যবিদ্যা নামেও অনেকে অভিহিত করেছেন। সৌভাগ্য অর্থে এখানে সুন্দর ভাগ্য, সাফল্য, সৌন্দর্য, আনন্দ, মোক্ষ প্রভৃতি কে বোঝানো হয়েছে এই পরম্পরার সাধনার মাধ্যমে যা সহজেই লাভ করা যায়। এই সমস্ত পদগুলি প্রায়শই ত্রিপুরসুন্দরী নামটিকে বিভিন্ন ত্রিত্বের "মা" হিসাবে দেবীর চরিত্র হিসাবে ব্যাখ্যা করে - এটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন পরম্পরার ব্যাখ্যাকারীরা এটিকে কাশ্মীরি শৈব অদ্বৈতবাদী ত্রিকা পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত করে। , "ত্রয়" অর্থে ব্যাখ্যা করা হয় (যা অমৃতানন্দকৃত যোগিনী হৃদয়ের-এর উপর যার ভাষ্যের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় তখন অস্পষ্ট ধারণাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে)। কামেশ্বর শিবের পত্নী হবার জন্যে দেবীকে কামেশ্বরী নামেও সম্বোধন করা হয়। দেবী কখনো কখনো ললিতা নামেও পরিচিতা ।
দেবী দশমহাবিদ্যা ও নিত্যাদেবীদের মধ্যে অন্যতমা । তিনি ষোড়শী নামেও পরিচিতা (পরব্রহ্ম ষোলটি কলা ধারণ করেন)। দেবীর সঙ্গে ত্রিপুরভৈরবী ও বালাসুন্দরীও সম্পর্কিতা । ভারতীয় দেবদেবীদের সাধারণতঃ দুরকম মূর্তিতত্ত্ব পাওয়া যায় - সৌম্য ও রৌদ্র । দেবী ত্রিপুরসুন্দরীকে সৌম্য রূপে দেখানো হয়, যেখানে তিনি ত্রিনয়না, অর্ধেন্দুধারিণী, চতুর্ভূজা , রক্ত বস্ত্র পরিধানা, পদ্মাসীনা, চার হাতে পাশ, অঙ্কুশ, ধনুক ও বাণ ধারণ করেন।
দেবীর খুব কমই প্রস্তরমূর্তি বা ভাষ্কর্য পাওয়া যায় যদ্যপি চিত্রকর্মের প্রাচুর্য দেখা যায়। সাধারণঃ শ্রী চক্রে দেবীর উপাসনা করা হয় এবং মানসপটে দেবীকে ধ্যান করতে হয়।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে যতদূর জানা যায়, শ্রীবিদ্যার প্রধান গ্রন্থদ্বয় হল বামকেশ্বরীমত তন্ত্র (যা নিত্যষোড়শীকার্ণব নামেও পরিচিত) এবং যোগিনী হৃদয় । এগুলি সম্ভবতঃ দশম শতাব্দীর ও পূর্বে রচিত । শাক্তকুলসম্রাট তথা ত্রিক আচার্য অভিনবগুপ্ত তাঁর দুটি গ্রন্থে উপরোক্ত গ্রন্থগুলিকে উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল - "পরা-ত্রীশিকা-বিবরণ" ও "মালিনীবিজয়বার্তৃকা" ।
শ্রীচক্রের পূজার চিহ্ন দক্ষিণের তামিল শৈবদের তিরুমন্তিরম এ। আধুনিক শ্রীবিদ্যা পরম্পরায় একটি বিশ্বাস আছে যে, আদি শংকরাচার্য শৃঙ্গেরীতে শ্রীচক্রসহ শারদাম্বামূর্তি স্থাপন করেন। কিন্তু এটা নিছকই কল্পনা । কারণ তৎকালীন সময়ে সমস্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ত্রিপুরাসুন্দরী পূজিত হত।
দেবী ত্রিপুরার ক্রমটি সুবিশাল কৌল পরম্পরা চারটি আম্নায়ের মধ্যে অন্যতম যা তান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বিকশিত হয়েছিল মূলতঃ কাপালিক দের বিশ্বাস ও অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে। শ্রীবিদ্যা পরম্পরার উৎপত্তি হয়েছিল কাশ্মীরে (আরো বিস্তারিতভাবে ওডিয়ান শক্তিপীঠ থেকে) ।
সেইসব দিব্যভাবের অর্থাৎ উর্ধ্বাম্নায় সম্প্রদায়ের সাধকেরা মহাবিশ্ব ব্যাপ্তকারী প্রধান দেবী/দেবতা এবং তাঁর আবরণ , পরিবার দেবতা র সাধনায় আবিষ্ট ছিলেন ।
সেই আবরণ বা পরিবারমণ্ডলের যোগিনীরা সমষ্টিগতভাবে এক একটি গোত্র বা কুল এর মধ্যে গণ্য হতেন । এইভাবেই কুল বা কৌলপ্রথার উৎপত্তি। এই সাধনপ্রণালী প্রাচীনকালে যোগী, কাপালিকদের চেয়ে গৃহস্থরা বেশি পালন করতেন। ত্রৈপুর পরম্পরা (ও বিভিন্ন কৌলতন্ত্র) র বিভিন্ন গ্রন্থে এই তন্ত্রদর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও রহস্যময়তার সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।
কৌল পরম্পরা প্রধানতঃ চারটি ভাগে বিভক্ত (পরে ছয়টি) । কম্পাসের কাটার মত প্রধান চারটি দিক এর নাম অনুসারে (সদাশিব এর চারটি দিকে থাকা মস্তক অনুযায়ী) আম্নায়গুলির নাম হয়েছে - পূর্বাম্নায়, উত্তরাম্নায়, পশ্চিমাম্নায় ও দক্ষিণাম্নায়।
পূর্বাম্নায় কে সবচেয়ে প্রাচীন কৌল পরম্পরা বলা হয় (বাস্তবে এখানে পূর্ব মানে দিক নয়, বরং আগে বা পূর্ববর্তী বোঝানো হয়) । এর কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় ( পীঠস্থান - Pīṭhas, গুরু পরম্পরা- Lineages ,পরিভাষা- coded language ও আচার- rituals) যা বাকি আম্নায়গুলিতেও প্রকাশিত হয়। এই প্রণালীতে পঞ্চ-ম-কারের মৈথুনী ক্রিয়া ও ছিল । ত্রিক পরম্পরা এই আম্নায় থেকে বিকশিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই কারণে "স্পন্দন" তত্ত্বের উৎপত্তি হয়েছে। ত্রিক পরম্পরা বহুদিন পূর্বেই বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু অদ্বৈতবাদী কাশ্মীরি শৈবদের মাধ্যমে আজও কিছুটা টিকে আছে।
উত্তরাম্নায় কালীক্রমের সূচক। এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। একটি "মত পরম্পরা" যা অখ্যাত হওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দ্বিতীয়টি হচ্ছে "ক্রম" যেটি আজ কালীকুল নামে বিখ্যাত। এখানে দেবী ভৈরবের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। কিছু ক্রম সম্প্রদায়ের গ্রন্থ টিকে আছে, বাকিগুলো প্রক্ষিপ্ত। অন্যান্য কৌলগুরুদের মত আচার্য অভিনবগুপ্ত ও তাঁর ত্রিক দর্শন সম্পর্কিত লেখায় ক্রম ব্যবস্থা র আলোচনা করেছেন, যেমন - যোগিনীহৃদয়ের ভাষ্য। তৃতীয় অংশটি হল নেপালের গুহ্যকালী পরম্পরা যা এখনো গুহ্যেশ্বরী পীঠে সাধনার মাধ্যমে টিকে আছে।
দক্ষিণাম্নায় প্রণালীর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন যোগিনীহৃদয়। এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী কামেশ্বরী ও ভৈরব কামেশ্বর। এটি প্রধানতঃ কাম সম্পর্কিত সাধন প্রণালী বা মৈথুনী ক্রিয়ার প্রক্রিয়া যা বামকেশ্বরীমত তন্ত্রে উল্লেখ আছে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চক্র বা যন্ত্রে সাধন। এই আম্নায়টি সবচেয়ে নবীন।
যাইহোক, অন্ততপক্ষে ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর শ্রীবিদ্যা সরাসরি দুটি অংশে ভেঙে যায়। দক্ষিণ ভারতের নবীন পরম্পরাটি শৃঙ্গেরীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেদান্তীকরণ(Vedantized) বা অ-তান্ত্রিকীকরণ (De-Tantricized)। এটি পরবর্তীতে শংকরাচার্য পরম্পরা গ্রহণ করেছিল।
চারটি আম্নায় (পরে ছয়টি) এর পৃথক পৃথক প্রধান দেবী বর্তমান। তা সত্ত্বেও এই পরম্পরাগুলির মধ্যে সাধারণভাবে কাপালিকদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এদের সাধনপ্রণালী(Rituals), সাধনার পরিভাষা( vocabulary ) প্রায় একরকম।
ত্রৈপুর সম্প্রদায়ের উৎপত্তি যে কাশ্মীরে এর সপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে। জয়রথ যিনি একজন কাশ্মীরি ছিলেন, তাঁর বামকেশ্বরীমতের ভাষ্যে কাশ্মীরে শ্রীবিদ্যার এক দীর্ঘ ঐতিহ্যপূর্ণ গুরু পরম্পরা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। শ্রীবিদ্যাসাধক শিবানন্দ (ত্রয়োদশ শতাব্দীর ভাষ্যকার)ও উক্ত আগমের ভাষ্যে কাশ্মীরি শ্রীবিদ্যা র ঐতিহ্যের উল্লেখ করেছেন।
তবে জয়রথের বর্ণনা অনুযায়ী আজকের কাশ্মীরে সৌভাগ্যক্রমের উৎপত্তি হয়নি বরং হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশে ওডিয়ান( Oḍīyāna ) বা ওড্ড্যান নামক স্থানের সোয়াট উপত্যকা(Swat Valley of kashmir) থেকে । সেটিও পূর্বে কাশ্মীর জনপদের অংশ ছিল (যা আজ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে) ।
এই অঞ্চলটি কুব্জিকামত তন্ত্রের মত প্রাচীন আগমের বর্ণনার পাওয়া যায়। প্রাচীন শাক্ত আগমে ওডিয়ানকে আদি শক্তিপীঠ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায়, শাক্ত ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎপত্তিস্থল হল এই সোয়াট উপত্যকা।
যোগিনীহৃদয়ের ভাষাতত্ত্ব ও শব্দভান্ডার এর সঙ্গে কাশ্মীরি আগমিক সাহিত্যের মিল লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীতে ক্ষেমরাজ কর্তৃক প্রত্যাভিজ্ঞা তে এটি আরো বিস্তৃত হয়েছে।
Comments
Post a Comment