একপঞ্চাশদ্ শক্তিপীঠ
একপঞ্চাশদ্ শক্তিপীঠ বা একান্ন পীঠ
সূচনা :—
পীঠ শব্দের অর্থ পবিত্র আসন (sacred seat)। সাধারণতঃ শাক্তধর্মে শক্তিদেবীর পবিত্র আবাস স্থলকেই পীঠ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে । শক্তিপীঠ অর্থ আদ্যাশক্তির পবিত্র তীর্থ। দক্ষযজ্ঞে কুব্জিকাদেবী দাক্ষায়ণী সতী স্বরূপের দেহ যোগাগ্নিতে ত্যাগ করলে, কুজেশ্বর মহাদেব তা দেখে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। সৃষ্টি নষ্ট হতে বসে, শুরু হয় মহাপ্রলয় । তাই তাঁকে শান্ত করার জন্য দেবী নিজে পালনকর্তা বিষ্ণুকে আদেশ করেন তাঁর পূর্ববর্তী দেহটিকে কর্তন করে ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এখানে দেবী নিজের তীর্থস্থান তৈরীর উদ্দেশ্যও অন্তর্নিহিত ছিল। তাই পরবর্তীতে পর্বতরাজের কন্যা সেইসব স্থানে গিয়ে নিজ স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করেন।
![]() |
দেহত্যাগরতা দাক্ষায়ণী |
সুপ্রাচীন ও প্রামাণ্য আগমসমূহ (যেমন — আম্নায় মঞ্জরী, অম্বামত সংহিতা, নিশিসঞ্চার তন্ত্র, মন্থনভৈরবাগম , রুদ্রযামলাগম , দেবীযামল ইত্যাদি) পীঠস্থানের বিশ্বাসযোগ্য তালিকার বিবরণ দিয়ে থাকে । এদের মধ্যে বিশেষ একান্ন শক্তিপীঠ এর মধ্যে একান্ন বর্ণের তত্ত্ব থাকায় সেগুলি প্রধান পীঠ ও বাকিগুলি উপপীঠ নামে পরিচিত।
শক্তিপীঠে সতী অঙ্গ পতিত হওয়ায় একে সতীপীঠ ও বলা হয়। দেবী ভাগবতেও ১০৮ শক্তিপীঠের তালিকা পাওয়া যায়। তবে তা শক্তিপীঠ হিসেবে গ্রহণযোগ্য কিনা তা নিয়ে দ্বিমত আছে । কারণ দেবী ভাগবত এর পূর্বেই পদ্ম পুরাণে সাবিত্রী মাহাত্ম্যে, স্কন্দপুরাণে, মৎস্য পুরাণে বিভিন্ন দেবীর তীর্থস্থল হিসেবে সেই তালিকাটি চিহ্নিত। তালিকায় রাধা,রুক্মিণী,বালিপত্নী তারা, উর্বশী প্রমুখের মন্দিরও আছে, যা শক্তিপীঠ এর ধারণার বিপ্রতীপ। তাই বরং চিন্তাবিদদের মতে সেই তালিকাটি অষ্টোত্তরশতদেবীস্থান নামে পরিচিত।
ষোড়শ শতকে "পীঠনির্ণয় তন্ত্র" তে অন্যরকম একান্ন শক্তিপীঠ এর তালিকা পাওয়া যায়। তবে মধ্যযুগীয় ধারণায় ভৌগলিক অজ্ঞানতার পাশাপাশি অর্বাচীন তীর্থকে পীঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। একান্ন শক্তিপীঠ এর প্রকৃত প্রামাণ্য তালিকা বামকেশ্বরীমত আগমের যোগিনী হৃদয় তন্ত্র, ললিতোপাখ্যান, মেরু তন্ত্রে পাওয়া যায়। সেই তালিকাই নিম্নে প্রদত্ত হল —
কামরূপং বারাণসীং নেপালং পৌণ্ড্রবর্ধনম্ । পুরস্থিরং* কান্যকুব্জং পূর্ণশৈলং তথার্বুদম্ ॥
আম্রাতকেশ্বরমেকাম্রং ত্রিস্রোতং কামকোটকম্ । কৈলাশং ভৃগুনগরং কেদারং চন্দ্রপুষ্করম্ ॥
শ্রীপীঠমোঙ্কারপীঠং¹ জালন্ধ্রং মালবন্তথা । কুলান্তং দেবিকোট্টং চ গোকর্ণং মারুতেশ্বরম্ ॥
অট্টহাসং চ বিরজং² রাজগৃহং মহাপথম্ । কোলাপুর³মেলাপুরং কালেশং চ জয়ন্তিকা ॥
উজ্জয়িনীং চিত্রাং⁴ চ ক্ষীরকং হস্তিনাপুরম্ । উড্ডীশং চ প্রয়াগাখ্যং ষষ্ঠীং মায়াপুরীং তথা ॥
জলেশং মলযং শৈলং⁵ মরুং গিরিবরং তথা । মাহেন্দ্রং বামনং চৈব হিরণ্যপুরমেব চ ॥
মহালক্ষ্মীপুরং⁶ ওড্যাণং ছায়াছত্রমতঃ পরম্ ॥
নোট—
* ললিতোপাখ্যানে পুরস্থির শব্দটির বদলে বরস্থির আছে । আবার কিছু তালিকায় পুরস্থির এর বদলে কাশ্মীরপীঠ (শারদা) র নামও আছে ।
¹ ললিতোপাখ্যানে ওঁকারপীঠ (ওঁকারেশ্বর) এর বদলে একবীরপীঠ উদ্ধৃত হয়েছে।
² বিরজ বলতে এখানে যজ্ঞপুর বা ওড়িশার জাজপুর কে বোঝানো হয়েছে। দেবীর নাম বিরজা। ওড্রপীঠ ও বলা হয় বিরজপীঠকে ।
³ কোলাপুর বলতে এখানে মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুর নয়, বরং কর্ণাটকের কোল্লুর কে বোঝানো হয়েছে।
⁴ সম্ভবতঃ চৈত্ররথ প্রদেশ ।
⁵ বিন্ধ্যবাসিনী শক্তিপীঠ কে শৈলপীঠ বলা হয়েছে।
⁶ মহালক্ষ্মীপুর হলো মহারাষ্ট্রের মহালক্ষ্মী অম্বাবাঈ মন্দির।
একান্ন শক্তিপীঠ তালিকা —
১॥ কামরূপ।
২॥বারাণসী।
৩॥ নেপাল।
৪॥ পৌণ্ড্রবর্ধন।
৫॥ পুরস্থির।
৬॥ কান্যকুব্জ।
৭॥ পূর্ণশৈল।
৮॥ অর্বুদ।
৯॥ আম্রাতকেশ্বর।
১০॥ একাম্র।
১১॥ ত্রিস্রোত।
১২॥ কামকোট্ট।
১৩॥ কৈলাস।
১৪॥ ভৃগুনগর।
১৫॥ কেদার।
১৬॥ চন্দ্রপুষ্কর।
১৭॥ শ্রী-পীঠ।
১৮॥ ওঁকারপীঠ।
১৯॥ জালন্ধর।
২০॥ মালব।
২১॥ কুলান্তক।
২২॥ দেবীকোট্ট।
২৩॥ গোকর্ণ।
২৪॥ মারুতেশ্বর।
২৫॥ অট্টহাস।
২৬॥ বিরজা।
২৭॥ রাজগৃহ।
২৮॥ মহাপথ।
২৯॥ কোলাপুর(কোল্লুর্)।
৩০॥ এলাপুর।
৩১॥ কালেশ্বর।
৩২॥ জযন্তিকা।
৩৩॥ উজ্জয়িনী।
৩৪॥ চিত্রা (চৈত্ররথ)।
৩৫॥ ক্ষীরক।
৩৬॥ হস্তিনাপুর।
৩৭॥ উড্ডীশ।
৩৮॥ প্রয়াগ
৩৯॥ ষষ্ঠীপুর
৪০॥ মায়াপুরী
৪১॥ জলেশ্বর।
৪২॥ মলয়।
৪৩॥ শৈল (বিন্ধ্য) ।
৪৪॥ মরুদেশ।
৪৫॥ গিরিবর।
৪৬॥ মহেন্দ্র-গিরি।
৪৭॥ বামনগিরি।
৪৮॥ হিরণ্যপুর।
৫০॥ ওড্ড্যান ।
৫১॥ ছায়াছত্র
পাঠকদের উদ্দেশ্যে — প্রতিটি পীঠের (যেগুলি নীলরঙে রঞ্জিত) নামে ক্লিক করলে তদুক্ত পীঠের পরিপূর্ণ তথ্যের ওয়েবপেজ খুলে যাবে ।
কিংশুকচ্ছদবিশাললোচনীং কিঞ্চ নাগরসবল্লিসংযুতাম্ ।
অঙ্গচম্পকসমানবর্ণিনীং শঙ্করপ্রিয়সতীং নমাম্যহম্ ॥
যাঁর নেত্রগুলি কিংশুক পুষ্পের ন্যায় বিশাল ও সুন্দর , যিনি নাগরপুষ্পমাল্যে সজ্জিতা, যাঁর অঙ্গকান্তি চম্পা ফুলের মত শ্বেত বর্ণের, সেই শংকরের প্রিয়া দাক্ষায়ণী সতীর ভজনা করি ।
Comments
Post a Comment