ওড্ড্যান পীঠ
॥ ওড্ড্যান আদি শক্তিপীঠ ॥
চতুরাদি শক্তিপীঠ সংকলন
প্রাককথন :—
শাক্ত সম্প্রদায়ের বিবিধ সুপ্রাচীন ও পবিত্র গ্রন্থানুসারে, চারটি বিশেষ স্থলকে শাক্ত ধর্মমতের জন্মস্থান বলে মনে করা হয়। তাদের একত্রে "চতুরাদি শক্তিপীঠ" বলে চিহ্নিত করা হয়। মনে করা হয়, এইসব পীঠস্থানগুলি থেকে ক্রমব্যবস্থা, কৌলমার্গ,আগমিক ধারা, শাক্ত পরম্পরার উদ্ভব হয়েছিল। কুব্জিকামত আগম, মন্থনভৈরবাগম, কালীকুলের সবিশেষ "জয়দ্রথযামল আগম", অম্বামত সংহিতা, আম্নায় মঞ্জরী প্রভৃতি তন্ত্রাগমে এসবের বিস্তৃত বর্ণনা মেলে। এমনকি, ব্রহ্মাণ্ড, ব্রহ্মবৈবর্ত, দেবী ভাগবত, অগ্নি,কালিকা -র মত পুরাণগুলিতেও এই স্থানগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়।
![]() |
পরাভট্টারিকা ওড্ড্যানেশ্বরী |
চার আদি শক্তিপীঠ হল—১) ওড্ড্যান/ ওডিয়ান, ২) জলন্ধর/জালন্ধর, ৩) পূর্ণগিরি/ পূর্ণশৈল ও ৪) কামরূপ।
এই লেখায় আমরা চার আদি শক্তিপীঠের প্রথমটি, অর্থাৎ ওড্ড্যান পীঠের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো ।
ওড্ড্যান মহাপীঠ:—
চতুরাদি শক্তিপীঠের প্রথমটি হ'ল ওড্ড্যান পীঠ । এটি ওডিয়ান, উড্ডীয়ান প্রভৃতি নামেও পরিচিত । গৌরী তন্ত্রানুসারে দেবী ত্রিপুরসুন্দরী হলেন ওড্ড্যানপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, —
ওড্ড্যানে মহাপীঠে দেবী ত্রিপুরসুন্দরী।
কুণ্ডাকৃতমহারণ্যে পরমামৃতবিগ্রহা ॥
ওড্ড্যান পীঠে দেবী সতীর সহস্রার চক্র অর্থাৎ মস্তকের সর্বোচ্চ অংশ পড়েছিল বলে মনে করা হয়। সহস্রার হ'ল ষটচক্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ তথা সর্বপ্রধান অংশ । এই চক্রের মাধ্যমেই জীবাত্মার মুক্তি ঘটে । তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। উত্তর তন্ত্র অনুযায়ী, — "ললাটে পূর্ণগির্যাখ্যং ওড্ড্যানং সহস্রারম্ " । সতীর সহস্রার চক্রই হ'ল ত্রৈপুরক্রমের শ্রীযন্ত্র।
ওড্ড্যানের মূল পীঠস্থানটি কাশ্মীরের সোয়াট উপত্যকাতে অবস্থিত । যেমনভাবে কামরূপ ক্ষেত্রে মূল কামরূপ পীঠ ছাড়াও একাধিক উপপীঠ অবস্থিত, তেমনই এর চারপাশে কতিপয় উপপীঠ অবস্থিত। মন্থনভৈরব তন্ত্রের ৬৪ শক্তিপীঠ তালিকা অনুযায়ী, করবীর শ্মশান (সিদ্ধলক্ষ্মী শক্তিপীঠ) ওড্ড্যান ক্ষেত্রেই অবস্থিত ।
অবস্থান ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য:—
![]() |
শ্রীষোড়শীদেবী |
কামরূপং লিখেৎ পূর্বে কৌলগির্যন্তু দক্ষিণে।
চৌহারং পশ্চিমে লেখ্যং উত্তরে ওড্ড্যানং লিখেৎ ॥
মলয়ং চাগ্নিদিগ্ভাগে নৈঋত্যাং তু কুলান্তকম্।
জালন্ধরবায়ব্যে ঐশান্যে দেব্যকোট্টকম্ ॥
[[ তথ্যসূত্র:— কুলদীপিকা তন্ত্র: দ্বিতীয় পটল ]]
কুলদীপিকা তন্ত্র কতিপয় পীঠস্থানের ভৌগলিক অবস্থিতির বর্ণনা প্রসঙ্গে বলছে, ওড্ড্যান ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত ।
ঐতিহাসিক দীনেশ চন্দ্র সরকার ও ওড্ড্যান পীঠের সম্পর্কে তাঁর "দ্য শাক্ত পীঠস্ " (The Śākta Pīṭhas) গ্রন্থে বলেছেন যে সেটি কাশ্মীরের সোয়াট উপত্যকায় অবস্থিত। সকল ঐতিহাসিকই একথা স্বীকার করেন । কালিকাপুরাণ মতেও ওডিয়ান পীঠ উত্তরে অবস্থিত।
কামরূপ বলতে কামাখ্যা মন্দির ব্যতীত এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র তথা সমগ্র অসম রাজ্যকে বোঝায়, তেমনই ওড্ড্যান ক্ষেত্র আফগানিস্তান এর পূর্বাংশ, পাকিস্তানের কাশ্মীর ও পাক অধিকৃত ভারতীয় কাশ্মীর নিয়ে গঠিত । আধুনিককালে, আফগানিস্তানের ঘজ়নি (Ghazni)তে একটি মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে, যা কালিকাপুরাণের শ্লোককে প্রমাণ করে যে কাত্যায়নী দেবী ওড্ড্যানে পূজিতা হতেন । মূর্তিটি আনুমানিক ১২০০ বছরের ও বেশি পুরোনো ।
![]() |
মহিষমর্দিনী মূর্তির ধ্বংসাবশেষ |
এছাড়া, আফগানিস্তানের গার্ডেজ় এ খ্রিষ্টীয় নবম শতকের একটি প্রকাণ্ড গণেশের মূর্তি পাওয়া গেছিল, যার পাদবেদীতে খোদাই করা ওড্ড্যান রাজ্যের রাজা খিঙ্গলের আদেশে নির্মিত মহাবিনায়ক মূর্তি। এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু প্রমাণ করে যে ওড্ড্যান ক্ষেত্রে আগমিক পরম্পরার প্রচলন ছিল।
![]() |
মহাবিনায়ক মূর্তি |
ওড্ড্যান নামকরণের কারণ :—
![]() |
ত্রিপুরসুন্দরী দেবী |
কুব্জিকামত তন্ত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে একবার দেবী কুব্জিকা বা কুব্জিকেশ্বরী পশ্চিম হিমগহবরে গিয়েছিলেন যেখানে ওলাম্বিকা নামে এক বনরক্ষিকা (বনপালিকা) ছিলেন।
"এবমুক্তা গতাদূরং পশ্চিমং হিমগহ্বরম্ ॥ ৩৬"
[[ তথ্যসূত্র:— কুব্জিকামত তন্ত্রের দ্বিতীয় পটল]]
বনরক্ষিকা এবং অনেক পরিচারকারা মিলে দেবী হৈমবতী কুব্জিকাকে সেবা করেছিলেন। দেবী তাদের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন,
"ওড্ডিতা যেন অঙ্ঘ্রিভ্যাং তেনেদং ওড্ড্যানকম্ ॥৪১"
বায়ুমার্গে ওড্ড্যয়নের মাধ্যমে আমি(কুব্জিকা) এখানে পদার্পণ করায় এর নাম রাখলাম ওড্ড্যান।
শ্রীবিদ্যার মূল বামকেশ্বরীমত তন্ত্র বা যোগিনী হৃদয় তন্ত্রে বারংবার ওড্ড্যান এর নাম আছে, এবং উক্ত গ্রন্থের ৫১ শক্তিপীঠ তালিকার ৫০তম পীঠ হল ওড্ড্যান। ব্রহ্মাণ্ড মহাপুরাণের ললিতোপাখ্যানেও সেই একই ৫১ পীঠের তালিকা পাওয়া যায় । অনেকেই ওড্ড্যান পীঠের সঙ্গে ওড়িশা কে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু, যোগিনী হৃদয় বা ললিতোপাখ্যানে ওড়িশার বিরজাদেবীর পীঠস্থানকে "বিরজপীঠ" ও বিমলাকে "উড্ডীশ" পীঠ বলে চিহ্নিত করেছে। সুতরাং ওড্ড্যান আর ওড্রদেশ পৃথক।
আম্নায় ব্যবস্থায় ওড্ড্যান:—
আম্নায় ব্যবস্থা হল শাক্ত ও কৌলশৈব(ত্রিক, কাপালিক, সিদ্ধান্ত প্রভৃতি) সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় বারাহী তন্ত্র, পরা তন্ত্র প্রভৃতিতে। বারাহী তন্ত্র মতে, ওড্ড্যানপীঠ হল ঊর্ধ্বাম্নায় এর সূচক এবং ত্রিপুরসুন্দরী হলেন ঊর্ধ্বাম্নায়নায়িকা। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে,
ব্রহ্মশক্তি সমুল্লাসপীঠগহ্বরবিগ্রহা॥
ওড্ড্যানপীঠনিলয়া পরম্ব্রহ্মাত্মিকা শিবা ।
সর্বচক্রেশ্বরী সর্বপীঠেশ্বরী মন্ত্রবিগ্রহা ॥
সর্বমন্ত্রেশ্বরী সর্বদেবেশী দিব্যবিগ্রহা।
ওড্ড্যানপীঠনিলয়া পরম্ব্রহ্মাত্মিকা শিবা ॥
[[ তথ্যসূত্র:— বারাহী তন্ত্র : ২২ পটল]]
ঊর্ধ্বাম্নায় দমনারোহণ পদ্ধতি গ্রন্থে ওড্ড্যানেশ্বরী শ্রীসুন্দরী দেবীর পূজা পদ্ধতি বর্ণিত আছে । নীচে গ্রন্থানুসার ধ্যানটি প্রদত্ত হল,
সোমসূর্যাগ্নিনেত্রা চ দাডিম্বকুসুমোপমা।
পাশাঙ্কুশত্রিনেত্রাঞ্চ পঞ্চবাণধনুর্ধরা ॥
ব্রহ্মচক্রস্থিতাদেবী জ্ঞানশক্তিস্বরূপিণী।
ওড্ড্যানে মহাদেবী সৌভাগ্যায়ৈ নমোঽস্তুতে ॥
ঐতিহাসিকদের মান্যতানুসারে শ্রীবিদ্যা তথা শ্রীকুলের উৎপত্তি কাশ্মীরেই ঘটেছিল । একথা অমৃতানন্দনাথ, ভাষ্কররায়ের মত শাক্তাচার্যরাও মেনেছেন ।
শ্রীবিদ্যা এবং ওড্ড্যান মহাপীঠ:—
![]() |
শ্রীচক্ররাজনিলয়া |
কাশ্মীরি সাহিত্যে সৌভাগ্যা দেবীকে বারংবার "ত্রিকূটা" নামে সম্বোধন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রুদ্রযামলের কথা বলা যায়। এর একটি অংশ "ত্রিকূটা রহস্য" শ্রীবিদ্যার অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ঐতিহাসিকদের ধারণা, ত্রিকূটা থেকেই কাশ্মীরি দর্শন "ত্রিক" নামটি পেয়েছে। ত্রৈপুরক্রমের "কামকলা বিলাস" গ্রন্থে ত্রিক দর্শনই প্রতিফলিত হয়েছে । কামকলা বিলাসের প্রথম শ্লোকেই প্রকাশ-বিমর্ষের তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে, যা ত্রিক দর্শনের প্রধান তত্ত্ব।
যোগিনী হৃদয় বা বামকেশ্বরীমত তন্ত্র হ'ল ত্রৈপুরক্রমের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ। অমৃতানন্দনাথ তাঁর যোগিনী হৃদয় তন্ত্রের ভাষ্যে বলেছেন, মহেশ্বর হলেন প্রকাশ ও তাঁর বিমর্ষ শক্তিই হলেন ত্রিপুরসুন্দরী। কালীকুলসম্রাট মহামাহেশ্বর আচার্য অভিনবগুপ্ত তাঁর পরা-ত্রীশিকা-বিবরণ এবং মালিনীবিজয়বার্তিক গ্রন্থদ্বয়ে বারংবার যোগিনীহৃদয় তথা বামকেশ্বরীমত কে উদ্ধৃত করেছেন।
ওড্ড্যানপীঠের সঙ্গে জড়িত শাক্তাচার্যগণ :—
১) কল্যাণদেব, ২) পরমানন্দ, ৩) ত্রিলোচনেশ, ৪) দেবেশ, ৫) স্বাত্মানন্দ, ৬) অভিনবগুপ্ত
অন্যান্য রাজ্যের শাক্তাচার্যগণ যাঁরা ওড্যানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত :—
পুণ্যানন্দনাথ (ত্রয়োদশ শতকের হাদিবিদ্যার সাধক), অমৃতানন্দনাথ (পুণ্যানন্দনাথের শিষ্য, অন্ধ্রপ্রদেশবাসী, যোগিনী হৃদয়ের টীকাকার), শিবানন্দনাথ (নিত্যষোড়শীকার্ণব এর টীকাকার),
উপরোক্ত আচার্যগণ কাশ্মীর দর্শন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এঁরা সকলেই কৌলসাধক ছিলেন, স্মার্তকর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না।
অবশাক্ত(শাক্ত নয়,এমন) সাধক যাঁরা শ্রীবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত:—
১) শ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভু (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য)
২) কুমারগুরুবর (দক্ষিণী শৈব),
৩) অভিরামী ভট্ট,
৪) নীলকণ্ঠ দীক্ষিত (শৈবাচার্য)
৫) গৌড়পাদস্বামী (স্মার্তাচার্য)
৬) আদি শংকর (স্মার্তদের জগৎগুরু তথা, স্মার্ত শাংকরী পরম্পরার জনক)
৭) সুরেশ্বর (স্মার্তদের জগৎগুরু তথা শংকরাচার্য)
৮) রামানুজাচার্য (শ্রীবৈষ্ণব পরম্পরা)
শ্রীবিদ্যার উৎপত্তি কাশ্মীর অঞ্চলে হয়েছিল একথা বোঝাই যাচ্ছে। পরবর্তীতে শ্রীবিদ্যাকে ভৌগলিকভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। উত্তর ভারতের শ্রীবিদ্যা আবর্তিত হয় ওড্যানকে ঘিরে । অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতের সৌভাগ্যক্রম কামকোট্ট পীঠ (তামিলনাড়ুর কাঞ্চীপুর) কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ললিতোপাখ্যান হ'ল দক্ষিণী ত্রৈপুরক্রমের প্রধান গ্রন্থ। এখানে কাঞ্চীপুরের মহিমাই প্রধানতঃ আলোচিত হয়েছে। তৎসত্ত্বেও এই গ্রন্থ বহুবার ওড্ড্যানের উল্লেখ করেছে।
ওড্ড্যাণপীঠ-নিলয়া বিন্দু-মণ্ডলবাসিনী ।
রহোয়াগ-ক্রমারাধ্যা রহস্তর্পণ-তর্পিতা ॥ ৮৩॥
~ ললিতা সহস্রনামস্তোত্র
Comments
Post a Comment