জালন্ধর পীঠ
জালন্ধর আদি শক্তিপীঠ
চতুরাদি শক্তিপীঠ সংকলন
সূচনা:—
পূর্বে চার আদি শক্তিপীঠের প্রথমটি অর্থাৎ ওডিয়ান পীঠ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় আদিপীঠ অর্থাৎ জালন্ধর মহাপীঠের বর্ণনা করছি। ক্রমব্যবস্থার সঙ্গে এই পীঠের সংযোগ আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় । জালন্ধর পীঠের উল্লেখ প্রায় সমস্ত রকম শক্তিপীঠের তালিকাতেই পাওয়া যায় । বিশেষকরে— অম্বামত সংহিতা, মহাকাল সংহিতা, মন্থনভৈরবাগম, রুদ্রযামলাগম প্রভৃতি শাক্তাগমে বর্ণিত হয়েছে । দেবীভাগবতের এর নাম পাওয়া যায় — "জালন্ধরে বিশ্বতোমুখী" । এই পীঠের মাহাত্ম্য সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে পদ্ম মহাপুরাণের জালন্ধর মাহাত্ম্য খণ্ডে (বর্তমানে এই অংশটি মূল পদ্মপুরাণ হতে বিচ্ছিন্ন, তথাপি নারদ পুরাণে অষ্টাদশ মহাপুরাণের বিষয়বস্তু বর্ণনা প্রসঙ্গে এর উল্লেখ পাওয়া যায়, যা একে প্রামাণিক ঘোষণা করে)।
![]() |
শ্রীমত্তারাদেবী |
জালন্ধর আদিপীঠ:—
দ্বিতীয় আদি শক্তিপীঠ হ'ল জালন্ধর মহাপীঠ যা জলন্ধর, জালশৈল, জালন্ধর, জলন্ধ্র, জ্বালপীঠ প্রভৃতি নামেও সম্যকভাবে পরিচিত । জালন্ধর মাহাত্ম্য খণ্ড অনুযায়ী, জালন্ধর অঞ্চলে পাঁচটি পীঠ অবস্থিত। —
বজ্রেশ্বরী জয়ন্তী চ রম্যা জ্বালামুখী শিবা ।
অম্বিকা চ জগদ্বন্দ্যা জালন্ধরকৃতালয়া ॥ ৪॥
[[ তথ্যসূত্র:— পদ্মপুরাণান্তর্গত জালন্ধর মাহাত্ম্য: প্রথম অধ্যায়]]
বজ্রেশ্বরী, জয়ন্তী, রম্যা (অঞ্জনী), জ্বালামুখী ও অম্বিকা হলেন এই পাঁচ পীঠের দেবী। এদের মধ্যে বজ্রেশ্বরীই হলেন জালন্ধর আদিপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীর মন্দির হিমাচল প্রদেশের কাংড়াতে অবস্থিত।
![]() |
বজ্রেশ্বরী মন্দির, কাংড়া, হিমাচল প্রদেশ |
বজ্রেশ্বরী জয়ন্তী চ অঞ্জনী অম্বিকাস্তথা।
জ্বালামুখ্যা মহাদেব্যা পঞ্চতৈর্মোক্ষদায়িকা ॥
জালন্ধর মাহাত্ম্যের এই শ্লোক অনুযায়ী, মহাদেবীর পাঁচ স্বরূপ — বজ্রেশ্বরী, জয়ন্তী, অঞ্জনী, অম্বিকা ও জ্বালামুখী ; মোক্ষ প্রদান করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উক্ত পঞ্চদেবীদের মধ্যে অঞ্জনীদেবী হলেন হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুরে অবস্থিতা কালিকারূপিণী নৈনাদেবী এবং অম্বিকা হলেন ছিন্নমস্তা স্বরূপা চিন্তাপূর্ণী দেবী । জয়ন্তী দেবীর মন্দির হিমাচল প্রদেশের মজরী গ্রামে অবস্থিত এবং এটি জ্বালামুখীর উপপীঠ হিসেবে স্বীকৃত।
জলন্ধর পীঠের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বজ্রেশ্বরী বা বজ্রতারিণী ।
জালন্ধর মাহাত্ম্যের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকেই তা প্রতিপাদিত হয়ে যায়,
বজ্রেশ্বরী জগদ্রূপা সর্বমঙ্গলদায়িকা।
করোতু সর্বকালং মে মঙ্গলানি শিবপ্রিয়া ॥২॥
অর্থ —হে সত্য জগৎরূপিণী বজ্রেশ্বরী ! তুমি সর্ব বস্তুর মঙ্গল সাধন করো । হে মঙ্গলকারিণী শিবের অর্ধাঙ্গিনী, তোমাকে প্রণাম।
কিন্তু অন্যান্য কিছু সূত্র অনুযায়ী, জালন্ধর মহাপীঠের সঙ্গে জ্বালামুখীর মুখ্যতঃ সংযোগ আছে,
আকর্ষয়ন্তী সর্বাত্মা জ্বালামালা করালিনী।
অনাহতে তু সংপ্রাপ্তা যা সা হংসবিকাশিনী ॥
জ্বালামুখী সমাখ্যাতা পীঠে জ্বালসংজ্ঞকে।
[[ তথ্যসূত্র:— মন্থনভৈরবাগম: কুমারিকা খণ্ড : ৩৫ আনন্দ]]
অর্থ — দেবী করালিনী জ্বালামাল্যের দ্বারা সর্ববস্তু আকর্ষণ করেন । অনাহত চক্রে (চক্রস্থিত কুলকুণ্ডলিনীযুক্ত সাধকের কাছে) তিনিই "সঃ-অহং" তত্ত্ব প্রকাশ করেন । জ্বালামুখী নামে তিনি জ্বালপীঠের অধিষ্ঠাত্রী হন।
![]() |
জ্বালামুখী দেবী |
তবে, মন্থনভৈরবাগমের ৬৪ শক্তিপীঠ তালিকায় জ্বালামুখীকে জয়ন্তীপীঠ এবং বজ্রেশ্বরীকে জালন্ধর পীঠ বলে পৃথক পৃথক ভাবে উল্লেখ করেছে।
এছাড়া, জালন্ধরপীঠে সতীর স্তনযুগল ও জ্বালামুখীতে সতীর জিহ্বা পতিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তাই দুটি পূর্ণতঃ স্বতন্ত্র।
দিব্যে জালন্ধরে ক্ষেত্রে হরিণামলবুদ্ধিতা ।
সতীকুচতটে রম্যে হরসংস্থাপিতে শুভে ॥ ৪৬॥
অর্চিতা ভক্তিভাবেন দেবী শ্রীবজ্রচণ্ডিকা।
[[ জালন্ধর মাহাত্ম্য : ২২ অধ্যায়]]
অবস্থান ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য :—
পূর্বেকার ওড্যান পোস্টেই আলোচিত হয়েছে কুলদীপিকা তন্ত্র মতে জালন্ধর ভারতের বায়ব্যকোণ অর্থাৎ উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত।
"জালন্ধরন্তবায়ব্যে ঐশানে দেবীকোট্টকম্"
প্রাচীন জালন্ধর জনপদ আজকের পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ ও হরিয়ানা প্রদেশগুলি নিয়ে গঠিত। ঐ জনপদের রাজধানী জলন্ধর নগরী হল আজকের পাঞ্জাবের জলন্ধর। তাই অনেকেই শক্তিপীঠের অবস্থান হিসেবে পাঞ্জাবের জলন্ধর শহরে নির্দেশ করে থাকেন। কিন্তু এটি সত্য নয় । পূর্বেই আলোচিত হয়েছে, কাংড়ার বজ্রেশ্বরী মন্দিরই হল জলন্ধরপীঠ। যথা জালন্ধরমাহাত্ম্যে —
স্নাত্বা তু বাণগঙ্গায়াং পূজয়েৎ অম্বিকাসুতঃ।
বজ্রেশ্বরী চ তনাস্তি সার্ধকে ক্রোশপূণ্যকে ॥
অর্থ — বাণগঙ্গা নদীতে স্নান করে তৎপার্শ্বে গণেশের পূজা করতে হবে। গণেশ মন্দিরের থেকে অর্ধক্রোশ দূরে বজ্রেশ্বরীর পূণ্যধাম অবস্থিত।
![]() |
সতীস্তনস্বরূপ শিলা, বজ্রেশ্বরী দেবী |
এই পীঠের মন্দির কতবার এবং কোন কোন শাসকের নির্দেশে পুনর্নির্মিত হয়েছে, তা জানা যায়না। ১০০৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ পূর্বপাঞ্জাব (বর্তমান হিমাচল প্রদেশ) এ প্রবেশ করেন ও কাংড়ার নগরকোটের এই মন্দির ধ্বংস করেন। প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণ,রৌপ্য ও মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠিত হয় বর্বর ম্লেচ্ছদের দ্বারা । মাহমুদ-আক্রমণ-পূর্ববর্তী যুগের ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষ এখনো পাওয়া যায়। যা থেকে বোঝা যায়, পূর্বে এখানে অতি উন্নতমানের উত্তরভারতীয় নাগরশৈলীর স্থাপত্য ছিল। প্রাচীন মহিষমর্দিনী,পার্বতী, ভৈরব, হেরুক এর মূর্তি দ্রষ্টব্য। পরবর্তীকালে মধ্যযুগীয় কাংড়া শৈলীতে মন্দির নির্মিত হয়।
![]() |
বজ্রেশ্বরী মন্দিরে প্রাচীন হরগৌরী মূর্তি |
জালন্ধর নামকরণ :—
কুব্জিকামত আগমের দ্বিতীয় পটলে বলা হয়েছে যে,—
এবং দত্ত্বা বরং তেভ্যঃ করালঞ্চ সমাগতা।
মহাজ্বালালিসন্দীপ্তং দীপ্ততেজানলপ্রভম্ ॥৫০॥
(ওড্ড্যানের পরিচারিকাদের) বর প্রদান করে দেবী কুব্জিকা করাল নামক স্থানে এলেন। স্থানটি দেবীর দেহবিনিসৃত তেজঃপুঞ্জে প্রদীপ্ত হ'ল । জ্বালাতেজে প্রজ্জ্বলিত হওয়ায়, করালপুরের নাম হ'ল জালন্ধর।
দেবীর করালবদনা স্বরূপ বিনির্গত হ'ল এবং ভগবতী সেই রূপের উদ্দেশ্যে বললেন,
করালবদনে তুভ্যং মায়াজালপ্রসারিকে।
জালন্ধরাধিপত্যং ভবিষ্যত্যচিরেণ তু ॥৫৪॥
হে মায়াজাল বিস্তার করে থাকা করালবদনে! তুমি এক্ষণে জালন্ধর মহাপীঠের অধিষ্ঠাত্রী হলে।
বিবিধ শাস্ত্রে উল্লেখ :—
ললিতোপাখ্যানের ৫১ শক্তিপীঠ তালিকায় এর উল্লেখ আছে, —
"শ্রীপীঠং চৈকবীরঞ্চ জালন্ধরং মালবন্তথা ॥"
[[ ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ : ললিতোপাখ্যান]]
মন্থনভৈরবাগম অনুযায়ী,
জালন্ধরস্থিতাদেবীং কামলক্ষ্মীং জগৎপ্রভাম্।
ফলেশ্বরসমায়ুক্তাং অলক্ষ্মীতমোনাশিনীম্ ॥
জালন্ধর দেবী কামলক্ষ্মী রূপে অবস্থান করেন। তিনি ফলেশ্বর শিবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমগ্র জগতে প্রভা বিস্তার করে অলক্ষ্মী রূপা অন্ধকার নাশ করেন।
জ্ঞানার্নব তন্ত্রেও এই স্থানের নাম আছে,
কামরূপঞ্চ মলয়ং ততঃ কৌলগিরিন্তথা।
কুলান্তকঞ্চ চৌহারং জলন্ধরমতঃ পরম্ ॥
![]() |
নৈনাদেবী, বিলাসপুর |
আম্নায় ব্যবস্থায় জালন্ধর মহাপীঠ :—
তাঁরাদেবী বামমার্গের দেবী । চীনাচারে দেবীর উপাসনা করা হয়। চতুরাদি শক্তিপীঠের জালন্ধর পীঠ উত্তরাম্নায়ের প্রতীক । উত্তর আম্নায় বামাচারের নির্দেশক । এর কিঞ্চিৎ নিদর্শন জালন্ধর মাহাত্ম্যেও পাওয়া যায় —
[[ জালন্ধর মাহাত্ম্য : দ্বিতীয় অধ্যায় ]]
ক্রমব্যবস্থার ইতিহাসে জালন্ধরপীঠের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে । কৌলাচার্য মহামাহেশ্বর আচার্য অভিনবগুপ্তের গুরুদেব আচার্য শম্ভুনাথ বজ্রেশ্বরীপীঠেই সাধনা করতেন । তাঁর গুরু পরম্পরা মৎস্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে জড়িত। শম্ভুনাথই অভিনবগুপ্তকে কালীক্রমে দীক্ষা প্রদান করেছিলেন।
Comments
Post a Comment