মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা
মহালক্ষ্মীপুর শক্তিপীঠ
কোল্হাপুর, মহারাষ্ট্র
( পোস্টটি শাক্ত সম্প্রদায়ের মত, দর্শন ভিত্তিক। এখানে পঞ্চরাত্র, বৈষ্ণবশাস্ত্র প্রামাণ্য নয়, তাই যদি ব্যক্তিরা এতে আগ্রহী না হন, বিরক্ত না হন বা এ বিষয়ে কোনও সমস্যা খুঁজে না পান, তবে তাঁদের বলা হচ্ছে তাঁরা পোস্টটি এড়িয়ে চলুন।)
সূচনা:—
মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুর একটি প্রসিদ্ধ শাক্তক্ষেত্র। এই শহরটি অম্বাবাঈ মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা মন্দিরের জন্য সুবিখ্যাত।
![]() |
ললিতারূপিণী মহালক্ষ্মী |
মহালক্ষ্মী —ব্যুৎপত্তি :—
"মহা"— শব্দটি এসেছে "√মহ্+ঘ্+টাপ্" থেকে যেখানে "টাপ্" প্রত্যয়ের বিলোপ ঘটে "মহা" শব্দরূপ তৈরী হয়েছে এবং এটি "মহৎ" এর সমধাতুজ শব্দরূপ ।
মহা শব্দের অর্থ মহান, বিশাল, উদার, বিস্তৃত ইত্যাদি।
"লক্ষ্মী" — শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে "√লক্ষ্+ণিচ্+মুট্" থেকে । এখানে "মুট্" প্রত্যয় পরিবর্তিত হয়ে "মী" তে পরিণত হচ্ছে।
"মাধবীয়ধাতুবৃত্তি" ব্যাকরণ গ্রন্থানুসার "লক্ষ্মী" র অর্থ "লক্ষদর্শনাঙ্কনয়ো" অর্থাৎ যিনি (স্ত্রী) সৃষ্টির সমস্ত কিছু লক্ষ্য/চাক্ষুষ করেন তিনিই হলেন লক্ষ্মী।
"সিদ্ধান্তকৌমুদী" র নিয়মানুযায়ী, শ্রী শব্দের উৎপত্তি "রাদানেলাদানেদ্বাবপিদানয়িতিচন্দ্রঃ" থেকে এবং "উণাদিকসূত্রম্" অনুযায়ী"লক্ষ্মী" শব্দোৎপত্তি ঘটেছে "লক্ষের্মুটচ" (পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে) যার অর্থ সংসারের সকল কিছুর সাক্ষী যিনি (স্ত্রী), তিনিই হলেন লক্ষ্মী।
মহালক্ষ্মী — একাধিক দেবীর পরিচয়:—
দেবীদের মধ্যে মহালক্ষ্মী বলতে সাধারণত সবচেয়ে বিখ্যাত বিষ্ণুদয়িতা লক্ষ্মী কে বোঝালেও বস্তুতঃ "মহালক্ষ্মী" বা "লক্ষ্মী" শব্দটি অন্যান্য অনেক দেবীদের উদ্দেশ্যেই খাটে ।
১) ধর্মজায়া লক্ষ্মী — দক্ষ প্রজাপতির অসংখ্য কন্যার মধ্যে একজন হলেন লক্ষ্মী, যিনি ধর্ম নামক দেবতাকে বিবাহ করেন ।
নামতো ধর্মপত্ন্যস্তাঃ কীর্ত্যমানা নিবোধ মে। কীর্তির্লক্ষ্মীধৃতির্মেধা পুষ্টিঃ শ্রদ্ধা ক্রিয়া তথা ॥১৪॥
বুদ্ধির্লজ্জা মতিশ্চৈব পত্ন্যো ধর্মস্য তা দশ । দারাণ্যেতানি ধর্মম্য বিহিতানি খয়ম্ভুবা ॥১৫॥
~ তথ্যসূত্র: মহাভারত: আদিপর্ব: অধ্যায় ৬৬ : শ্লোক ১৪
শিব মহাপুরাণ (২.১.১৬) অনুযায়ী দক্ষরাজের লক্ষ্ম্যাদি তেরোজন পুত্রীকে ধর্মের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়।
২) যক্ষিণী লক্ষ্মী — উড্ডামেশ্বর তন্ত্রে উল্লেখিত ৩৬ জন যক্ষিণী (একধরণের উপদেবী, যক্ষ এর স্ত্রীলিঙ্গ) -দের মধ্যে লক্ষ্মী নামক একজন যক্ষিণী আছেন । নিম্নমার্গীয় তন্ত্র সাধনায় যক্ষিণীরা সিদ্ধাই, ধন, যশ প্রদান করেন।
৩) গণেশপ্রিয়া লক্ষ্মী — লক্ষ্মী মহাগণপতির পত্নী রূপে বিবেচিত হন । ইনি পুষ্টীদেবী বা সিদ্ধিদেবীর স্বরূপ ।
কর্পূরামোদবক্ত্রাং অপরিমিতকৃপাপূর্ণ নেত্রারবিন্দাং শ্রীলক্ষ্মীং বল্লভাখ্যাং গণপতিহৃদয়াং বিশ্বভূত্যৈ নমামি॥
~ গণেশ পুরাণ : উপাসনা খণ্ড: অধ্যায় ৪৪ (মহাগণপতি সহস্রনামের পূর্ব অধ্যায়)
৪) কুবেরবনিতা মহালক্ষ্মী — বৈষ্ণবদের শাস্ত্র নারদ মহাপুরাণ নিজমুখে কুবেরপত্নীর নাম "মহালক্ষ্মী" ঘোষণা করেছেন ।
আলিঙ্গ্য সব্যহস্তেন বামে তাম্বুলধারিণম্ ।
ধনদাঙ্কসমারূঢাং মহালক্ষ্মীং প্রপূজয়েৎ॥
~ নারদ পুরাণ : পূর্বভাগ: অধ্যায় ৮৪ : শ্লোক ২৯
হস্তদ্বয় দ্বারা আলিঙ্গনরত, বামহস্তে তাম্বুল (পানপাতা) ধারিণী, কুবের বা ধনদের ক্রোড়ে স্থিতা মহালক্ষ্মীদেবীকে পূজা করি।
![]() |
নারদ পুরাণ |
৫) পরমশিবজায়া মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা —
বৈদিক সাহিত্যে লক্ষ্মী শব্দটি ঈশানপত্নী দাক্ষায়ণী সতীর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে ।
যো ব্রহ্ম ব্রহ্মণ উজ্জভার প্রাণেশ্বরঃ কৃত্তিবাসাঃ পিনাকী। ঈশানো দেবস্স ন আযুর্দধাতু তস্মৈ জুহোমি হবিষা ঘৃতেন স্বাহা ॥১৪॥ শ্রিয়ং লক্ষ্মীমৌপলামম্বিকাং গাং ষষ্ঠীং জয়ামিন্দ্রসেনেত্যুদাহুঃ তাং বিদ্যাং ব্রহ্মযোনিং সরূপামিহাযুষে তর্পযামো ঘৃতেন স্বাহা ॥১৭॥ দাক্ষায়ণ্যস্সর্বযোন্যস্সযোন্যস্সহস্রশো বিশ্বরূপা বিরূপাঃ সসূনবস্সপতযস্সযূথ্যা ইহাযুষেণো ঘৃতমিদং জুষন্তাং স্বাহা ॥১৮॥
~ বৌদ্ধায়ণ গুহ্যসূত্রম্ : প্রশ্ন ৩ : অধ্যায় ৭
আমি ভগবন্ ঈশানের উদ্দেশ্যে হবি অর্পন করি, যিনি ব্রহ্মার পিতা, সর্বপ্রাণের ঈশ্বর , যিনি গজচর্ম পরিধান করেন, এবং পিণাক ধারণ করেন। তিনি আমাদিগকে দীর্ঘ আয়ু প্রদান করুন । ১৪
আমি ঈশানের পত্নীকে হবি অর্পন করি যিনি সর্ববিদ্যার আকর , এবং যিনি শ্রী, লক্ষ্মী, ঔপলা, অম্বিকা, গা, ইন্দ্রসেনা নামে পরিচিতা । তিনিও আমাদের দীর্ঘায়ু করুন। ১৭
আমি ঈশানপত্নী দাক্ষায়ণী কে ঘৃতার্পন করি যিনি সর্ব জগতের মাতা, অসংখ্য রূপ ধারিণী ।
বিভিন্ন শাস্ত্রে মহালক্ষ্মীপুরের উল্লেখ:—
ঐতিহাসিক মান্যতা অনুযায়ী, মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুর এর নাম প্রাচীন সময়ে কোল্হাপুর / করবীরপুর কোনোটাই ছিল না। আগমে উল্লেখিত করবীর শ্মশান বস্তুতঃ কাশ্মীরের ওড্ড্যান (সোয়াট উপত্যকা) র নিকটস্থ মিঙ্গোরা শহর । আর কোলাপুর নামটি কর্ণাটকের কোল্লুর কে বোঝানো হতো (দ্রষ্টব্য স্কন্দপুরাণের কোলাপুর মাহাত্ম্য খণ্ড) । মহালক্ষ্মীপুর ছিল বর্তমান মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুর এর আগেকার নাম। পদ্ম মহাপুরাণের করবীর মাহাত্ম্য অনুযায়ী, দেবী পার্বতী সেখানে কোল্হাসুরকে বধ করার জন্য মহালক্ষ্মীপুরের নাম দেন কোল্হাপুর ও শিব করবীরাসুর কে বধ করে করবীরপুর নাম রাখেন। পূর্বকল্পে গৌরীদেবী বনদুর্গা রূপে কোল্লুর কৌলগিরি তে কোল্হাসুর বধ করেছিলেন। করবীরপুর আর করবীর শ্মশান তাই পৃথক।
ব্রহ্মাণ্ড মহাপুরাণের ললিতোপাখ্যানে ৫১ শক্তিপীঠ তালিকায় মহালক্ষ্মীপুরের উল্লেখ আছে —
"মহালক্ষ্মীপুরং ওড্যানং ছায়াছত্রমতঃ পরম্"
আচার্য গুহানন্দ বিরচিত নিপাতিন সংহিতার উমাক্ষেত্রবর্ণনে অবশ্য মহালক্ষ্মীপুরকে কোল্হাপুরই বলা হয়েছে,
"কোলাপুরে মহালক্ষ্মীশ্চাস্মি হালাস্যে শয়থলোচনী॥ "
![]() |
নিপাতিন সংহিতার পত্র |
গিরিজাদেবী কোলাপুরে মহালক্ষ্মী ও হালাস্যে শয়থলোচনী বা মীনাক্ষী নামে প্রসিদ্ধা।
বৃহন্নীলতন্ত্রের পঞ্চম পটলে বলা হয়েছে,
"মাতৃদেশে জগন্মাতা করবীরপুরে সতী"
কালিকাদেবী মাতৃদেশে জগন্মাতা (রেণুকা) ও করবীরপুরে সতী রূপে বিরাজিতা ।
মন্থনভৈরবাগমে বলা হয়েছে,
মহালক্ষ্মীবনে ঘোরে মহালক্ষ্মী জগৎসুখাম্ । নৌমি তুম্বুরুসংযুক্তাং বরদাভয়গোচরাম্ ॥
~ মন্থনভৈরব তন্ত্র : কুমারিকা খণ্ড : শক্তিপীঠ স্তব
মহালক্ষ্মী বনে দেবী মহালক্ষ্মী অবস্থিতা। তিনি তুম্বুরেশ্বর শিবের সঙ্গে নিবাস করেন।
অম্বামত সংহিতায় বলা হয়েছে,
মহালক্ষ্মীপুরে ঘোরে মহালক্ষ্মী জগৎসুখাম্ । নৌমি তুম্বুরুসংযুক্তাং বরদাভয়গোচরাম্ ॥
দেবীগীতায় গৌরীদেবী হিমবানকে বলছেন,
কোলাপুরং মহাস্থানং যত্র লক্ষ্মীঃ সদা স্থিতা ।
মাতুঃপুরং দ্বিতীয়ং চ রেণুকাধিষ্ঠিতং পরম্ ॥ ৫॥
~ দেবীভাগবত উপপুরাণ : দেবীগীতা: ৭ম অধ্যায়
কোলাপুর মহাস্থান যেখানে আমার (শৈলসুতার) লক্ষ্মী স্বরূপ সর্বদা স্থিত। মাতৃপুর দেবীর দ্বিতীয় স্থান যেখানে তাঁর রেণুকা রূপ অধিষ্ঠিত।
বৃহদ্ যোগিনী তন্ত্রে করবীরেশীকে ভীমেশ্বরী বলা হয়েছে,
বারাণস্যাং বিশালাক্ষী করবীরে ভীমেশ্বরী ॥
হরিতায়ণ সংহিতাতে ললিতার ১২ পীঠে করবীরপুরের উল্লেখ আছে,
করবীরে মহালক্ষ্মী কালিকা মালবেষু সা ॥
ভবিষ্য পুরাণেও পার্বতীকে মহালক্ষ্মী বলে সম্বোধন করা হয়েছে —
দুর্গা চামুণ্ডয়া সার্ধং নবদুর্গাসমন্বিতা। আদ্যা তাবন্মহালক্ষ্মীর্নদা ক্ষেমকরী তথা ॥৯
ভবিষ্য পুরাণ : উত্তর পর্ব : অধ্যায় ৬১
ভব/শিবের পত্নী নয়টি স্বরূপ ধারণ করেন । তিনি দুর্গা, চামুণ্ডা, মহালক্ষ্মী, ক্ষেমঙ্করী নামেও প্রসিদ্ধা ।
হৈমবতী দুর্গা একাধিক কল্পে কোলাসুরকে বধ করেছেন । মূকাম্বিকা, কৃত্যাদেবী, কালিকা, শৈলপুত্রী, মাতঙ্গী প্রমুখ ।
যোগিনী তন্ত্রে বলা হয়েছে,
শ্রীকাল্যুবাচ ।
ইদানীং রে বৎস বিষ্ণো হন্মি কোলান্সবান্ধবান্ । কোলানগরমাস্থায় কুমারীরূপমাস্থিতা ॥ ৮
~ যোগিনী তন্ত্র : পূর্বখণ্ড : অধ্যায় ১৭
দেবী বলিলেন, "পুত্র বিষ্ণু, আমি এখনি কুমারীরূপ ধারণপূর্বক কোলানগরে যাব ও সসাঙ্গকোলাদৈত্য বধ করবো।
এছাড়াও শাক্তাগমে মাতঙ্গিনী কৃত কোলাদৈত্য বধের উল্লেখ আছে।
মিথ্যা দাবির খণ্ডন :—
🔴পূর্বপক্ষ — মহালক্ষ্মী অষ্টকম্ দেবীকে বৈকুণ্ঠস্বামী বিষ্ণুর পত্নী বলেছে। এই স্তোত্রটি ইন্দ্রকৃত। —
🟢সমাধান —
ইন্দ্রকৃত মহালক্ষ্মী অষ্টকম্ এর কোনো প্রকৃত তথ্যসূত্র নেই । এটি আসলে শাক্তাগম উমাতন্ত্রের মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা স্তোত্র হইতে গৃহীত ও পরিবর্তিত একটি স্তোত্র । উমাতন্ত্রের উনবিংশতম পটলে বর্ণিত । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উমাতন্ত্রকে কালিকা পুরাণ ও উদ্ধৃত করেছে। মূল স্তোত্রটি পার্বত্যুপাসক অগস্ত্য বিরচিত । একই স্তোত্র পদ্মপুরাণান্তর্গত করবীর মাহাত্ম্য ও ভৃঙ্গিরিটি সংহিতাতে উদ্ধৃত হয়েছে।
আচার্য নীলকণ্ঠ ও তাঁর ভগবন্তভাষ্কর গ্রন্থে উমাতন্ত্র উদ্ধৃত করে উক্ত স্তোত্রটি প্রকাশ করেছিলেন ।
![]() |
ভগবন্তভাষ্কর এর পৃষ্ঠা |
🔴পূর্বপক্ষ — স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মীর কোলাপুরে বসবাস করার বিধান আছে । সুতরাং উনিই পীঠাধিষ্ঠাত্রী মহালক্ষ্মী।
🟢সমাধান —
এটা ঠিক যে ভগবতী রমা কোল্হাপুরে নিবাস করেন । কারণ দেবী মাহাত্ম্য অনুযায়ী, চণ্ডিকা ইন্দিরাদেবীর মাতা । সুতরাং কোল্হাপুর হলো রমাদেবীর মাত্রালয়। মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা মন্দিরের নিকটস্থ শ্রীলক্ষ্মী মন্দির আছে । সেখানেই দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া ইন্দিরা বাস করেন ।
![]() |
শ্রীলক্ষ্মী (বিষ্ণুপত্নী) মন্দির |
স্কন্দপুরাণ নিজেই কোলাসুরবিনাশিনী হিসেবে গিরিসুতার নামোচ্চারণ করেছে ।
তমায়ান্তং তদা দৃষ্ট্বাऽম্বিকা গিরিসুতা পশ্যতামেব সুরাণাং শিরঃ কাযাদপাহরত্ কোলাসুরো দেব্যা নিহতোদৈত্যঃ সসৈন্যবলবাহনঃ ॥
~ স্কন্দপুরাণ : মূকাম্বিকা মাহাত্ম্য খণ্ড : ১২
এছাড়া স্কন্দপুরাণ এর মানস খণ্ডে বলা হয়েছে,
দেবা ঊচুঃ-
দেব্যা যথা ত্রিভুবনং সচরাচরং চ ব্যাপ্তং বির্ভাষ ভুবনং চ ধরাধরং চ । শেষঃ ফণাশতশতৈরপি নম্রভূতো সা বৈ ধরাধরসুতাऽবতু দেবপালম্ ॥ ১৬ ॥
সংস্তুতা যা মহাদেবী ব্রহ্মণা পরমেষ্ঠিনা। যোগনিদ্রেতি বিখ্যাতা বিষ্ণোরতুলতেজসঃ ।।১৭।।
যযা ত্যক্তো জগন্নাথো জঘান মধুকৈটভৌ। আত্মকর্ণমলোদ্ভূতৌ মোহিতৌ যোগমাযযা ॥১৮॥ সাऽস্মানবতু কল্যাণী শুম্ভদৈত্যেন নির্জিতান্ । ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশানাং তেজোরাশিসমুদ্ভবা ।।১৯।। সংস্তুতা দেবগন্ধর্বে দিব্যশূলপ্রহারিণী। সাऽস্মানবতু কল্যাণী মহিষাসুরতাশিনী ।॥২০॥
দক্ষপ্রজাপতের্গে হে অবতীর্য মনোরমা। যা কালী গীযতে লোকে সাऽস্মানবতু শাঙ্করী ॥২১॥
স্কন্দপুরাণ : মানস খণ্ড : অধ্যায় ৯৭
পর্বতরাজের কন্যা, যিনি সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত এবং রক্ষা করেছেন, এবং যাঁর দর্শনে ভগবান শেষও বিনীতভাবে তাঁর অগণিত ফণা অবনত করেন, তিনি আমাদের সকলকে রক্ষা করুন। সেই দেবী, ব্রহ্মা যাঁর প্রশংসা নিজের সুরক্ষার জন্য করেছিলেন, তিনি আমাদের রক্ষা করুন। যিনি যোগমায়া হিসেবে ভগবান বিষ্ণুর চোখে বাস করে তাঁকে তাঁর নিদ্রা থেকে জাগিয়েছিলেন এবং বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে জন্ম নেওয়া মধু এবং কৈটভ রাক্ষসদের বিভ্রান্ত করেছিলেন এবং স্বয়ং বিষ্ণু দ্বারা তাদের বধ করেছিলেন, সেই দেবী আমাদের রক্ষা করুন। যিনি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিগত শক্তি থেকে প্রকাশিত হয়ে তাঁর দিব্য ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরকে ধ্বংস করেছিলেন, তিনি আমাদের রক্ষা করুন। যিনি দক্ষ প্রজাপতির ঘরে আবির্ভূত হয়ে কালী নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি আমাদের রক্ষা করুন।
স্কন্দপুরাণের অর্ধনারীশ্বরস্তোত্রে বলা হয়েছে,
নবাক্ষরীমনুস্তুত্যা পঞ্চাক্ষরমনুপ্রিয় ।
নবাবরণসম্পূজ্যা পঞ্চায়তনপূজিতঃ ॥
ভগবতী উমা নবাক্ষর মন্ত্র (নবার্ণ) দ্বারা পূজিতা ও ভগবান শিবের প্রিয় মন্ত্র পঞ্চাক্ষর (নমঃশিবায়)।
তদুক্ত পুরাণে বিষ্ণুকৃত পার্বতীস্তুতিতে দেবীকে মহালক্ষ্মী,মহাকালী ও মহাসরস্বতী বলা হয়েছে,
শ্রীবিষ্ণুরুবাচ ।
মহাব্রতে মহাদেবি মহাদেবপ্রিয়া সদা ।
ত্বং হি সত্ত্বরজঃস্থা চ তামসী শক্তিরুত্তমা ॥
ফলবেলা মহাকালী মহালক্ষ্মীঃ সরস্বতী ।
ওংকারশ্চ বষট্কারস্ত্বমেব হি সুরেশ্বরি ॥
~ স্কন্দপুরাণ: নাগর খণ্ড: তীর্থ মাহাত্ম্য: অধ্যায় ২৫১
এ থেকে স্কন্দপুরাণ বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর হয়।
এছাড়া পদ্ম মহাপুরাণের উত্তর খণ্ডের ১৫৭তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে গৌরীদেবী কৃত্যারূপ ধারণপূর্বক কোলাদৈত্য বধ করেন।
ব্রহ্মবিদ্যা সম্প্রদায়ের পৃথ্বীধরাচার্য প্রাধানিক রহস্যের মহালক্ষ্মীকে গিরিজা ভবানী বলেছেন,
বামে করে তদিতরে চ যথোপরিষ্টাত্ পাত্রং সুধারসভূতং বরমাতুলুঙ্গম্ । খেটং গদাং চ দধতীং ভবতী ভবানী ধ্যায়ন্তি যেঽরুণনিভাং কৃতিনস্ত এব।
~ লঘুসপ্তশতী: পৃথ্বীধরাচার্য
করবীর মাহাত্ম্য খণ্ডের প্রমাণ :—
পদ্মমহাপুরাণান্তর্গত করবীর মাহাত্ম্য হলো মহালক্ষ্মীপুর এর মাহাত্ম্য বর্ণনামূলক পৌরাণিক অংশ । গ্রন্থটির দুটি পাণ্ডুলিপি পূর্বে বোম্বাই মহাফেজখানাতে সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জালিক পত্রে (Website) সর্বসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত। উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে দেবীর সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে, নীচে তা তুলে ধরা হলো ।
মহালক্ষ্মীরুবাচ
ত্বং হি মদ্দক্ষিণে ভাগে নিত্যং সন্তিষ্ঠ পাবনঃ ।
মাহাত্ম্যং তব বৈ দৃষ্ট্বা ধৃতোসি মস্তকে ময়া ॥ ৩৩
~করবীর মাহাত্ম্য: অধ্যায় ২০
মহালক্ষ্মী (শিবের উদ্দেশ্যে) বলিলেন, হে দেব, সর্বদা আমার দক্ষিণভাগে বিরাজ করুন । আপনার কৃতিত্বের জন্য আমি আপনাকে মস্তকেও ধারণ করছি।
মহালক্ষ্মী সহস্রনামে বিষ্ণুদয়িতা পদবাচ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু উমাবাচক নাম অতি সহজেঈ মেলে,
উমা ভগবতী দেবী চণ্ডী দাক্ষায়ণী পুরা ॥
সহস্রনামের মধ্যে চণ্ডী, দাক্ষায়ণী, চণ্ডিকা, দুর্গা, শিবা, ত্রিপুরা, ভৈরবী, কামাক্ষী, কামদা, শুভা, ত্র্যম্বকা, ত্রিলোচনা, করবীরনিবসিনী, শঙ্করাত্মিকা, মহাদেবী, মহেশ্বরী, মাতৃকা, বৈষ্ণবী, ব্রাহ্মী, রৌদ্রী, নারসিংহী, লিঙ্গধারিণী, মহাকালী, কপালী, মহাগৌরী, মহালক্ষ্মীঃ, মহাসরস্বতী প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
করবীরপুরকে শাক্তরাজধানী ও বারাণসীকে শৈবরাজধানী বলা হয়েছে তদুক্ত গ্রন্থে —
কাশিকা চোত্তরে ভোগে করবীরং তুদক্ষিণে । শিবরুপেণ তত্রাস্তে শক্তিরূপেণচাত্রহি ॥
~ করবীর মাহাত্ম্য : দ্বিতীয় অধ্যায়
কাশী উত্তরদিকে অবস্থিত ও করবীরপুর দক্ষিণে । শিব কাশীতে ও শক্তি (গৌরী) করবীরপুরে সর্বদা বাস করেন ।
![]() |
করবীর মাহাত্ম্যের পাণ্ডুলিপি |
কদাচিশ্শিবশক্ত্যোস্তুবিবাদঃ সমজায়ত ।
সেখানে আরও বলা হয়েছে,
মৎক্ষেত্রং ব মহত্বপূর্ণং তব ক্ষেত্রং ব মহত্তপরম্ ॥ ২৯
এবং বিবাদতো স্তত্র শিবশক্ত্যোরূপাগতঃ।
~ করবীর মাহাত্ম্য : প্রথম অধ্যায়
ক্ষেত্রের মহত্ব নিয়েই এই দাম্পত্য কলহ , যার জেরে গিরিজাদেবী কৈলাস ত্যাগ করে প্রথমে হিমবানের আলয়ে ও পরে করবীরপুরে পৌঁছন। করবীরপুরে গিয়ে জানতে পারেন সেখানে কোলাসুর ও করবীরাসুর সেখানকার নাগরিকদের উপর অত্যাচার করছে । তারপর তিনি কোলাদৈত্য বধ করেন।
প্রথম অধ্যায়ে দেবীর দ্বাররক্ষক আবরণ দেবতা রূপে চারজন শিবশক্তির স্বরূপই রয়েছেন ।
কাত্যায়নীং মহাদেবীং দক্ষিণদ্বাররক্ষিণীম্ ॥ ৫১
পশ্চিমদ্বারপালস্তু শ্রীসিদ্ধবটুকেশ্বরঃ । ক্ষেত্রস্যোত্তরদিগ্ভাগে স্থিতোরত্নেশ্বরোমহান্ ॥ ৫২
ক্ষেত্রস্যপূর্বদিগ্ভাগে ত্র্যম্বুলী যত্রতিষ্ঠতি । দেব্যাদতবরোদর্কা লোকযাত্রাফলপ্রদাঃ॥ ৫৩
![]() |
সপ্তম অধ্যায়ের পত্র |
![]() |
চণ্ডিকাদেবী |
"সা ভগবতী পার্বত্যপি স্বাৎ শরীরকোশাৎ "
![]() |
আনন্দেশ্বর তন্ত্রের পাণ্ডুলিপি |
Comments
Post a Comment