মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা

 মহালক্ষ্মীপুর শক্তিপীঠ 

কোল্হাপুর, মহারাষ্ট্র 

( পোস্টটি শাক্ত সম্প্রদায়ের মত, দর্শন ভিত্তিক। এখানে পঞ্চরাত্র, বৈষ্ণবশাস্ত্র প্রামাণ্য নয়, তাই যদি ব্যক্তিরা এতে আগ্রহী না হন, বিরক্ত না হন বা এ বিষয়ে কোনও সমস্যা খুঁজে না পান, তবে তাঁদের বলা হচ্ছে তাঁরা পোস্টটি এড়িয়ে চলুন।) 

সূচনা:— 

মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুর একটি প্রসিদ্ধ শাক্তক্ষেত্র। এই শহরটি অম্বাবাঈ মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা মন্দিরের জন্য সুবিখ্যাত। 

ললিতারূপিণী মহালক্ষ্মী 
মহালক্ষ্মী শব্দটি দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হন । এই কারণে কিছু বিশেষ বৈষ্ণবরা অম্বাবাঈকে শ্রীনিবাস তিরুপতির পত্নী বলে দাবি করেন । কিন্তু এটি একটি কল্পনা মাত্র। এর কোনো প্রামাণিক তথ্য নেই। কোল্হাপুরের পূর্ব নাম মহালক্ষ্মীপুর এবং এটি একটি শক্তিপীঠ যেখানে সতীর দেহ অঙ্গ পতিত হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে আমরা এই পীঠের ইতিহাস, শাস্ত্রীয় তথ্যের প্রমাণ তুলে ধরছি।

মহালক্ষ্মী —ব্যুৎপত্তি :— 

"মহা"— শব্দটি এসেছে "√মহ্+ঘ্+টাপ্" থেকে যেখানে "টাপ্" প্রত্যয়ের বিলোপ ঘটে "মহা" শব্দরূপ তৈরী হয়েছে এবং এটি "মহৎ" এর সমধাতুজ শব্দরূপ । 

মহা শব্দের অর্থ মহান, বিশাল, উদার, বিস্তৃত ইত্যাদি। 

"লক্ষ্মী" — শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে "√লক্ষ্+ণিচ্+মুট্" থেকে । এখানে "মুট্" প্রত্যয় পরিবর্তিত হয়ে "মী" তে পরিণত হচ্ছে। 

"মাধবীয়ধাতুবৃত্তি" ব্যাকরণ গ্রন্থানুসার "লক্ষ্মী" র অর্থ "লক্ষদর্শনাঙ্কনয়ো" অর্থাৎ যিনি (স্ত্রী) সৃষ্টির সমস্ত কিছু লক্ষ্য/চাক্ষুষ করেন তিনিই হলেন লক্ষ্মী। 

"সিদ্ধান্তকৌমুদী" র নিয়মানুযায়ী, শ্রী শব্দের উৎপত্তি "রাদানেলাদানেদ্বাবপিদানয়িতিচন্দ্রঃ" থেকে এবং "উণাদিকসূত্রম্" অনুযায়ী"লক্ষ্মী" শব্দোৎপত্তি ঘটেছে "লক্ষের্মুটচ" (পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে) যার অর্থ সংসারের সকল কিছুর সাক্ষী যিনি (স্ত্রী), তিনিই হলেন লক্ষ্মী। 

মহালক্ষ্মী — একাধিক দেবীর পরিচয়:— 

দেবীদের মধ্যে মহালক্ষ্মী বলতে সাধারণত সবচেয়ে বিখ্যাত বিষ্ণুদয়িতা লক্ষ্মী কে বোঝালেও বস্তুতঃ "মহালক্ষ্মী" বা "লক্ষ্মী" শব্দটি অন্যান্য অনেক দেবীদের উদ্দেশ্যেই খাটে । 

১) ধর্মজায়া লক্ষ্মী — দক্ষ প্রজাপতির অসংখ্য কন্যার মধ্যে একজন হলেন লক্ষ্মী, যিনি ধর্ম নামক দেবতাকে বিবাহ করেন । 

নামতো ধর্মপত্ন্যস্তাঃ কীর্ত্যমানা নিবোধ মে। কীর্তির্লক্ষ্মীধৃতির্মেধা পুষ্টিঃ শ্রদ্ধা ক্রিয়া তথা ॥১৪॥ 

বুদ্ধির্লজ্জা মতিশ্চৈব পত্ন্যো ধর্মস্য তা দশ । দারাণ্যেতানি ধর্মম্য বিহিতানি খয়ম্ভুবা ॥১৫॥ 

~ তথ্যসূত্র: মহাভারত: আদিপর্ব: অধ্যায় ৬৬ : শ্লোক ১৪ 

শিব মহাপুরাণ (২.১.১৬) অনুযায়ী দক্ষরাজের লক্ষ্ম্যাদি তেরোজন পুত্রীকে ধর্মের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। 

২) যক্ষিণী লক্ষ্মী — উড্ডামেশ্বর তন্ত্রে উল্লেখিত ৩৬ জন যক্ষিণী (একধরণের উপদেবী, যক্ষ এর স্ত্রীলিঙ্গ) -দের মধ্যে লক্ষ্মী নামক একজন যক্ষিণী আছেন । নিম্নমার্গীয় তন্ত্র সাধনায় যক্ষিণীরা সিদ্ধাই, ধন, যশ প্রদান করেন। 

৩) গণেশপ্রিয়া লক্ষ্মী — লক্ষ্মী মহাগণপতির পত্নী রূপে বিবেচিত হন । ইনি পুষ্টীদেবী বা সিদ্ধিদেবীর স্বরূপ । 

কর্পূরামোদবক্ত্রাং অপরিমিতকৃপাপূর্ণ নেত্রারবিন্দাং শ্রীলক্ষ্মীং বল্লভাখ্যাং গণপতিহৃদয়াং বিশ্বভূত্যৈ নমামি॥ 

~ গণেশ পুরাণ : উপাসনা খণ্ড: অধ্যায় ৪৪ (মহাগণপতি সহস্রনামের পূর্ব অধ্যায়) 

৪) কুবেরবনিতা মহালক্ষ্মী — বৈষ্ণবদের শাস্ত্র নারদ মহাপুরাণ নিজমুখে কুবেরপত্নীর নাম "মহালক্ষ্মী" ঘোষণা করেছেন । 

আলিঙ্গ্য সব্যহস্তেন বামে তাম্বুলধারিণম্ ।

ধনদাঙ্কসমারূঢাং মহালক্ষ্মীং প্রপূজয়েৎ॥  

~ নারদ পুরাণ : পূর্বভাগ: অধ্যায় ৮৪ : শ্লোক ২৯ 

হস্তদ্বয় দ্বারা আলিঙ্গনরত, বামহস্তে তাম্বুল (পানপাতা) ধারিণী, কুবের বা ধনদের ক্রোড়ে স্থিতা মহালক্ষ্মীদেবীকে পূজা করি। 

নারদ পুরাণ


৫) পরমশিবজায়া মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা — 

বৈদিক সাহিত্যে লক্ষ্মী শব্দটি ঈশানপত্নী দাক্ষায়ণী সতীর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে । 

যো ব্রহ্ম ব্রহ্মণ উজ্জভার প্রাণেশ্বরঃ কৃত্তিবাসাঃ পিনাকী। ঈশানো দেবস্স ন আযুর্দধাতু তস্মৈ জুহোমি হবিষা ঘৃতেন স্বাহা ॥১৪॥ শ্রিয়ং লক্ষ্মীমৌপলামম্বিকাং গাং ষষ্ঠীং জয়ামিন্দ্রসেনেত্যুদাহুঃ তাং বিদ্যাং ব্রহ্মযোনিং সরূপামিহাযুষে তর্পযামো ঘৃতেন স্বাহা ॥১৭॥ দাক্ষায়ণ্যস্সর্বযোন্যস্সযোন্যস্সহস্রশো বিশ্বরূপা বিরূপাঃ সসূনবস্সপতযস্সযূথ্যা ইহাযুষেণো ঘৃতমিদং জুষন্তাং স্বাহা ॥১৮॥

~ বৌদ্ধায়ণ গুহ্যসূত্রম্ : প্রশ্ন ৩ : অধ্যায় ৭ 

আমি ভগবন্ ঈশানের উদ্দেশ্যে হবি অর্পন করি, যিনি ব্রহ্মার পিতা, সর্বপ্রাণের ঈশ্বর , যিনি গজচর্ম পরিধান করেন, এবং পিণাক ধারণ করেন। তিনি আমাদিগকে দীর্ঘ আয়ু প্রদান করুন । ১৪ 

আমি ঈশানের পত্নীকে হবি অর্পন করি যিনি সর্ববিদ্যার আকর , এবং যিনি শ্রী, লক্ষ্মী, ঔপলা, অম্বিকা, গা, ইন্দ্রসেনা নামে পরিচিতা । তিনিও আমাদের দীর্ঘায়ু করুন। ১৭ 

আমি ঈশানপত্নী দাক্ষায়ণী কে ঘৃতার্পন করি যিনি সর্ব জগতের মাতা, অসংখ্য রূপ ধারিণী । 

অম্ভাসাং পতয়ে চৈব ওজসাং পতয়ে নমঃ । নমোস্তু লক্ষ্মীপতয়ে শ্রীপায় ক্ষিতিপায় চ ॥২৪॥
~ লিঙ্গপুরাণ : পূর্বার্ধ: অধ্যায় ২১ : শিবস্তুতি

জলের অধিকারী, তেজের অধিপতি, লক্ষ্মীদেবীর স্বামী শিবকে নমস্কার। 

নমোऽস্তু লক্ষ্মীপতয়ে শ্রীমতে হ্রীমতে নমঃ ॥১১১॥
~ বায়ুপুরাণের তদুক্ত অধ্যায় 

লক্ষ্মীপতি, শ্রী ও হ্রী এর অধিকারী শিবকে নমস্কার।

বিভিন্ন শাস্ত্রে মহালক্ষ্মীপুরের উল্লেখ:— 

ঐতিহাসিক মান্যতা অনুযায়ী, মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুর এর নাম প্রাচীন সময়ে কোল্হাপুর / করবীরপুর কোনোটাই ছিল না। আগমে উল্লেখিত করবীর শ্মশান বস্তুতঃ কাশ্মীরের ওড্ড্যান (সোয়াট উপত্যকা) র নিকটস্থ মিঙ্গোরা শহর । আর কোলাপুর নামটি কর্ণাটকের কোল্লুর কে বোঝানো হতো (দ্রষ্টব্য স্কন্দপুরাণের কোলাপুর মাহাত্ম্য খণ্ড) । মহালক্ষ্মীপুর ছিল বর্তমান মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুর এর আগেকার নাম। পদ্ম মহাপুরাণের করবীর মাহাত্ম্য অনুযায়ী, দেবী পার্বতী সেখানে কোল্হাসুরকে বধ করার জন্য মহালক্ষ্মীপুরের নাম দেন কোল্হাপুর ও শিব করবীরাসুর কে বধ করে করবীরপুর নাম রাখেন। পূর্বকল্পে গৌরীদেবী বনদুর্গা রূপে কোল্লুর কৌলগিরি তে কোল্হাসুর বধ করেছিলেন। করবীরপুর আর করবীর শ্মশান তাই পৃথক। 

ব্রহ্মাণ্ড মহাপুরাণের ললিতোপাখ্যানে ৫১ শক্তিপীঠ তালিকায় মহালক্ষ্মীপুরের উল্লেখ আছে — 

"মহালক্ষ্মীপুরং ওড্যানং ছায়াছত্রমতঃ পরম্" 

আচার্য গুহানন্দ বিরচিত নিপাতিন সংহিতার উমাক্ষেত্রবর্ণনে অবশ্য মহালক্ষ্মীপুরকে কোল্হাপুরই বলা হয়েছে, 

"কোলাপুরে মহালক্ষ্মীশ্চাস্মি হালাস্যে শয়থলোচনী॥ "

নিপাতিন সংহিতার পত্র

গিরিজাদেবী কোলাপুরে মহালক্ষ্মী ও হালাস্যে শয়থলোচনী বা মীনাক্ষী নামে প্রসিদ্ধা। 

বৃহন্নীলতন্ত্রের পঞ্চম পটলে বলা হয়েছে, 

"মাতৃদেশে জগন্মাতা করবীরপুরে সতী" 

কালিকাদেবী মাতৃদেশে জগন্মাতা (রেণুকা) ও করবীরপুরে সতী রূপে বিরাজিতা । 

মন্থনভৈরবাগমে বলা হয়েছে,

মহালক্ষ্মীবনে ঘোরে মহালক্ষ্মী জগৎসুখাম্ । নৌমি তুম্বুরুসংযুক্তাং বরদাভয়গোচরাম্ ॥ 

~ মন্থনভৈরব তন্ত্র : কুমারিকা খণ্ড : শক্তিপীঠ স্তব 

মহালক্ষ্মী বনে দেবী মহালক্ষ্মী অবস্থিতা। তিনি তুম্বুরেশ্বর শিবের সঙ্গে নিবাস করেন। 

অম্বামত সংহিতায় বলা হয়েছে, 

মহালক্ষ্মীপুরে ঘোরে মহালক্ষ্মী জগৎসুখাম্ । নৌমি তুম্বুরুসংযুক্তাং বরদাভয়গোচরাম্ ॥

দেবীগীতায় গৌরীদেবী হিমবানকে বলছেন, 

কোলাপুরং মহাস্থানং যত্র লক্ষ্মীঃ সদা স্থিতা । 

মাতুঃপুরং দ্বিতীয়ং চ রেণুকাধিষ্ঠিতং পরম্ ॥ ৫॥ 

~ দেবীভাগবত উপপুরাণ : দেবীগীতা: ৭ম অধ্যায় 

কোলাপুর মহাস্থান যেখানে আমার (শৈলসুতার) লক্ষ্মী স্বরূপ সর্বদা  স্থিত। মাতৃপুর দেবীর দ্বিতীয় স্থান যেখানে তাঁর রেণুকা রূপ অধিষ্ঠিত। 

বৃহদ্ যোগিনী তন্ত্রে করবীরেশীকে ভীমেশ্বরী বলা হয়েছে, 

বারাণস্যাং বিশালাক্ষী করবীরে ভীমেশ্বরী ॥ 

হরিতায়ণ সংহিতাতে ললিতার ১২ পীঠে করবীরপুরের উল্লেখ আছে, 

করবীরে মহালক্ষ্মী কালিকা মালবেষু সা ॥ 

ভবিষ্য পুরাণেও পার্বতীকে মহালক্ষ্মী বলে সম্বোধন করা হয়েছে — 

দুর্গা চামুণ্ডয়া সার্ধং নবদুর্গাসমন্বিতা। আদ্যা তাবন্মহালক্ষ্মীর্নদা ক্ষেমকরী তথা ॥৯ 

ভবিষ্য পুরাণ : উত্তর পর্ব : অধ্যায় ৬১ 

ভব/শিবের পত্নী নয়টি স্বরূপ ধারণ করেন । তিনি দুর্গা, চামুণ্ডা, মহালক্ষ্মী, ক্ষেমঙ্করী নামেও প্রসিদ্ধা । 

হৈমবতী দুর্গা একাধিক কল্পে কোলাসুরকে বধ করেছেন । মূকাম্বিকা, কৃত্যাদেবী, কালিকা, শৈলপুত্রী, মাতঙ্গী প্রমুখ । 

যোগিনী তন্ত্রে বলা হয়েছে, 

শ্রীকাল্যুবাচ ।

ইদানীং রে বৎস বিষ্ণো হন্মি কোলান্সবান্ধবান্ । কোলানগরমাস্থায় কুমারীরূপমাস্থিতা ॥ ৮ 

~ যোগিনী তন্ত্র : পূর্বখণ্ড : অধ্যায় ১৭

দেবী বলিলেন, "পুত্র বিষ্ণু, আমি এখনি কুমারীরূপ ধারণপূর্বক কোলানগরে যাব ও সসাঙ্গকোলাদৈত্য বধ করবো। 

এছাড়াও শাক্তাগমে মাতঙ্গিনী কৃত কোলাদৈত্য বধের উল্লেখ আছে। 

মিথ্যা দাবির খণ্ডন :— 

🔴পূর্বপক্ষ — মহালক্ষ্মী অষ্টকম্ দেবীকে বৈকুণ্ঠস্বামী বিষ্ণুর পত্নী বলেছে। এই স্তোত্রটি ইন্দ্রকৃত। — 

🟢সমাধান — 

ইন্দ্রকৃত মহালক্ষ্মী অষ্টকম্ এর কোনো প্রকৃত তথ্যসূত্র নেই । এটি আসলে শাক্তাগম উমাতন্ত্রের মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা স্তোত্র হইতে গৃহীত ও পরিবর্তিত একটি স্তোত্র । উমাতন্ত্রের উনবিংশতম পটলে বর্ণিত । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উমাতন্ত্রকে কালিকা পুরাণ ও উদ্ধৃত করেছে। মূল স্তোত্রটি পার্বত্যুপাসক অগস্ত্য বিরচিত । একই স্তোত্র পদ্মপুরাণান্তর্গত করবীর মাহাত্ম্য ও ভৃঙ্গিরিটি সংহিতাতে উদ্ধৃত হয়েছে। 


আচার্য নীলকণ্ঠ ও তাঁর ভগবন্তভাষ্কর গ্রন্থে উমাতন্ত্র উদ্ধৃত করে উক্ত স্তোত্রটি প্রকাশ করেছিলেন । 

ভগবন্তভাষ্কর এর পৃষ্ঠা


🔴পূর্বপক্ষ — স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মীর কোলাপুরে বসবাস করার বিধান আছে । সুতরাং উনিই পীঠাধিষ্ঠাত্রী মহালক্ষ্মী।

🟢সমাধান — 

এটা ঠিক যে ভগবতী রমা কোল্হাপুরে নিবাস করেন । কারণ দেবী মাহাত্ম্য অনুযায়ী, চণ্ডিকা ইন্দিরাদেবীর মাতা । সুতরাং কোল্হাপুর হলো রমাদেবীর মাত্রালয়। মহালক্ষ্মী চণ্ডিকা মন্দিরের নিকটস্থ শ্রীলক্ষ্মী মন্দির আছে । সেখানেই দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া ইন্দিরা বাস করেন । 

শ্রীলক্ষ্মী (বিষ্ণুপত্নী) মন্দির 

স্কন্দপুরাণ নিজেই কোলাসুরবিনাশিনী হিসেবে গিরিসুতার নামোচ্চারণ করেছে । 

তমায়ান্তং তদা দৃষ্ট্বাऽম্বিকা গিরিসুতা পশ্যতামেব সুরাণাং শিরঃ কাযাদপাহরত্ কোলাসুরো দেব্যা নিহতোদৈত্যঃ সসৈন্যবলবাহনঃ ॥

~ স্কন্দপুরাণ : মূকাম্বিকা মাহাত্ম্য খণ্ড : ১২

এছাড়া স্কন্দপুরাণ এর মানস খণ্ডে বলা হয়েছে, 

দেবা ঊচুঃ-

দেব্যা যথা ত্রিভুবনং সচরাচরং চ ব্যাপ্তং বির্ভাষ ভুবনং চ ধরাধরং চ । শেষঃ ফণাশতশতৈরপি নম্রভূতো সা বৈ ধরাধরসুতাऽবতু দেবপালম্ ॥ ১৬ ॥

সংস্তুতা যা মহাদেবী ব্রহ্মণা পরমেষ্ঠিনা। যোগনিদ্রেতি বিখ্যাতা বিষ্ণোরতুলতেজসঃ ।।১৭।। 

যযা ত্যক্তো জগন্নাথো জঘান মধুকৈটভৌ। আত্মকর্ণমলোদ্ভূতৌ মোহিতৌ যোগমাযযা ॥১৮॥ সাऽস্মানবতু কল্যাণী শুম্ভদৈত্যেন নির্জিতান্ । ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশানাং তেজোরাশিসমুদ্ভবা ।।১৯।। সংস্তুতা দেবগন্ধর্বে দিব্যশূলপ্রহারিণী। সাऽস্মানবতু কল্যাণী মহিষাসুরতাশিনী ।॥২০॥ 

দক্ষপ্রজাপতের্গে হে অবতীর্য মনোরমা। যা কালী গীযতে লোকে সাऽস্মানবতু শাঙ্করী ॥২১॥

স্কন্দপুরাণ : মানস খণ্ড : অধ্যায় ৯৭ 

পর্বতরাজের কন্যা, যিনি সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত এবং রক্ষা করেছেন, এবং যাঁর দর্শনে ভগবান শেষও বিনীতভাবে তাঁর অগণিত ফণা অবনত করেন, তিনি আমাদের সকলকে রক্ষা করুন। সেই দেবী, ব্রহ্মা যাঁর প্রশংসা নিজের সুরক্ষার জন্য  করেছিলেন, তিনি আমাদের রক্ষা করুন। যিনি যোগমায়া হিসেবে ভগবান বিষ্ণুর চোখে বাস করে তাঁকে তাঁর নিদ্রা থেকে জাগিয়েছিলেন এবং বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে জন্ম নেওয়া মধু এবং কৈটভ রাক্ষসদের বিভ্রান্ত করেছিলেন এবং স্বয়ং বিষ্ণু দ্বারা তাদের বধ করেছিলেন, সেই দেবী আমাদের রক্ষা করুন। যিনি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিগত শক্তি থেকে প্রকাশিত হয়ে তাঁর দিব্য ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরকে ধ্বংস করেছিলেন, তিনি আমাদের রক্ষা করুন। যিনি দক্ষ প্রজাপতির ঘরে আবির্ভূত হয়ে কালী নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি আমাদের রক্ষা করুন। 

স্কন্দপুরাণের অর্ধনারীশ্বরস্তোত্রে বলা হয়েছে, 

নবাক্ষরীমনুস্তুত্যা পঞ্চাক্ষরমনুপ্রিয় ।

নবাবরণসম্পূজ্যা পঞ্চায়তনপূজিতঃ ॥ 

ভগবতী উমা নবাক্ষর মন্ত্র (নবার্ণ) দ্বারা পূজিতা ও ভগবান শিবের প্রিয় মন্ত্র পঞ্চাক্ষর (নমঃশিবায়)। 

তদুক্ত পুরাণে বিষ্ণুকৃত পার্বতীস্তুতিতে দেবীকে মহালক্ষ্মী,মহাকালী ও মহাসরস্বতী বলা হয়েছে,

শ্রীবিষ্ণুরুবাচ ।

মহাব্রতে মহাদেবি মহাদেবপ্রিয়া সদা । 

ত্বং হি সত্ত্বরজঃস্থা চ তামসী শক্তিরুত্তমা ॥ 

ফলবেলা মহাকালী মহালক্ষ্মীঃ সরস্বতী ।

ওংকারশ্চ বষট্কারস্ত্বমেব হি সুরেশ্বরি ॥ 

~ স্কন্দপুরাণ: নাগর খণ্ড: তীর্থ মাহাত্ম্য: অধ্যায় ২৫১

এ থেকে স্কন্দপুরাণ বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর হয়। 

এছাড়া পদ্ম মহাপুরাণের উত্তর খণ্ডের ১৫৭তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে গৌরীদেবী কৃত্যারূপ ধারণপূর্বক কোলাদৈত্য বধ করেন। 

ব্রহ্মবিদ্যা সম্প্রদায়ের পৃথ্বীধরাচার্য প্রাধানিক রহস্যের মহালক্ষ্মীকে গিরিজা ভবানী বলেছেন,

বামে করে তদিতরে চ যথোপরিষ্টাত্ পাত্রং সুধারসভূতং বরমাতুলুঙ্গম্ । খেটং গদাং চ দধতীং ভবতী ভবানী ধ্যায়ন্তি যেঽরুণনিভাং কৃতিনস্ত এব। 

~ লঘুসপ্তশতী: পৃথ্বীধরাচার্য 

করবীর মাহাত্ম্য খণ্ডের প্রমাণ :— 

পদ্মমহাপুরাণান্তর্গত করবীর মাহাত্ম্য হলো মহালক্ষ্মীপুর এর মাহাত্ম্য বর্ণনামূলক পৌরাণিক অংশ । গ্রন্থটির দুটি পাণ্ডুলিপি পূর্বে বোম্বাই মহাফেজখানাতে সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জালিক পত্রে (Website) সর্বসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত। উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে দেবীর সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে, নীচে তা তুলে ধরা হলো । 

মহালক্ষ্মীরুবাচ 

ত্বং হি মদ্দক্ষিণে ভাগে নিত্যং সন্তিষ্ঠ পাবনঃ । 

মাহাত্ম্যং তব বৈ দৃষ্ট্বা ধৃতোসি মস্তকে ময়া ॥ ৩৩ 

~করবীর মাহাত্ম্য: অধ্যায় ২০

মহালক্ষ্মী (শিবের উদ্দেশ্যে) বলিলেন, হে দেব, সর্বদা আমার দক্ষিণভাগে বিরাজ করুন । আপনার কৃতিত্বের জন্য আমি আপনাকে মস্তকেও ধারণ করছি। 

মহালক্ষ্মী সহস্রনামে বিষ্ণুদয়িতা পদবাচ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু উমাবাচক নাম অতি সহজেঈ মেলে, 

উমা ভগবতী দেবী চণ্ডী দাক্ষায়ণী পুরা ॥ 

সহস্রনামের মধ্যে চণ্ডী, দাক্ষায়ণী, চণ্ডিকা, দুর্গা, শিবা, ত্রিপুরা, ভৈরবী, কামাক্ষী, কামদা, শুভা, ত্র্যম্বকা, ত্রিলোচনা, করবীরনিবসিনী, শঙ্করাত্মিকা, মহাদেবী, মহেশ্বরী, মাতৃকা, বৈষ্ণবী, ব্রাহ্মী, রৌদ্রী, নারসিংহী, লিঙ্গধারিণী, মহাকালী, কপালী, মহাগৌরী, মহালক্ষ্মীঃ, মহাসরস্বতী প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। 

করবীরপুরকে শাক্তরাজধানী ও বারাণসীকে শৈবরাজধানী বলা হয়েছে তদুক্ত গ্রন্থে — 

কাশিকা চোত্তরে ভোগে করবীরং তুদক্ষিণে । শিবরুপেণ তত্রাস্তে শক্তিরূপেণচাত্রহি ॥  

~ করবীর মাহাত্ম্য  : দ্বিতীয় অধ্যায় 

কাশী উত্তরদিকে অবস্থিত ও করবীরপুর দক্ষিণে । শিব কাশীতে ও শক্তি (গৌরী) করবীরপুরে সর্বদা বাস করেন । 

করবীর মাহাত্ম্যের পাণ্ডুলিপি
করবীর মাহাত্ম্য এর প্রথম অধ্যায়েই বলা হয়েছে শিব ও পার্বতীর মধ্যে নিজ নিজ তীর্থের প্রাধান্য বিষয়ে কলহ উৎপন্ন হয় । 

কদাচিশ্শিবশক্ত্যোস্তুবিবাদঃ সমজায়ত । 

সেখানে আরও বলা হয়েছে, 

মৎক্ষেত্রং ব মহত্বপূর্ণং তব ক্ষেত্রং ব মহত্তপরম্ ॥ ২৯

এবং বিবাদতো স্তত্র শিবশক্ত্যোরূপাগতঃ। 

~ করবীর মাহাত্ম্য  : প্রথম অধ্যায় 

ক্ষেত্রের মহত্ব নিয়েই এই দাম্পত্য কলহ , যার জেরে গিরিজাদেবী কৈলাস ত্যাগ করে প্রথমে হিমবানের আলয়ে ও পরে করবীরপুরে পৌঁছন। করবীরপুরে গিয়ে জানতে পারেন সেখানে কোলাসুর ও করবীরাসুর সেখানকার নাগরিকদের উপর অত্যাচার করছে । তারপর তিনি কোলাদৈত্য বধ করেন।  

প্রথম অধ্যায়ে দেবীর দ্বাররক্ষক আবরণ দেবতা রূপে চারজন শিবশক্তির স্বরূপই রয়েছেন । 

কাত্যায়নীং মহাদেবীং দক্ষিণদ্বাররক্ষিণীম্ ॥ ৫১

পশ্চিমদ্বারপালস্তু শ্রীসিদ্ধবটুকেশ্বরঃ । ক্ষেত্রস্যোত্তরদিগ্ভাগে স্থিতোরত্নেশ্বরোমহান্ ॥ ৫২ 

ক্ষেত্রস্যপূর্বদিগ্ভাগে ত্র্যম্বুলী যত্রতিষ্ঠতি । দেব্যাদতবরোদর্কা লোকযাত্রাফলপ্রদাঃ॥ ৫৩

~ করবীরমাহাত্ম্য : ১ম অধ্যায়
কাত্যায়নীদেবী দক্ষিণদ্বার রক্ষা করেন। সিদ্ধবটুকেশ্বর শিব পশ্চিমদ্বার , রত্নেশ্বর শিব উত্তরদ্বার ও ত্র্যম্বুলীদেবী পূর্বদ্বার রক্ষা করেন। 

ভগবতী ত্র্যম্বুলীদেবী

ভগবতী কাত্যায়নী 


সপ্তম অধ্যায়ে দেবীকে তাঁর আবরণ দেবতাদের সহিত বাল্যখিল্য মুনিরা পূজা করেছিলেন। 
নমোদেব্যৈ মহালক্ষ্ম্যৈ শিবায়ৈ সততং নমঃ ।
নমঃ শিবায়ৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাস্মতাম্ ॥
তাঁরা এই মন্ত্রে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন — 
সপ্তম অধ্যায়ের পত্র
🔴পূর্বপক্ষ — স্মার্তগুরু আদি শংকরাচার্য কুবলয়পুরে বৈষ্ণবদের লক্ষ্মীবাদ খণ্ডন করেছিলেন। এটিই বর্তমান কোলাপুর । কুবলয়পুর শব্দটি বিবর্তিত হয়ে কোলাপুর হয়েছে ।
🟢সমাধান — 
মহামূর্খের ন্যায় বক্তব্য । কুবলয় [√কু(=পৃথিবী)+বলয়] শব্দটির অর্থ নীল পদ্ম। অপরদিকে কোল্হা বা কোলা শব্দটির অর্থ শেয়ার বা শৃগাল। তদুক্ত অসুরের মুখ শৃগালাকৃতি হবার দরুন তার নাম কোল্হাসুর হয়। একাধিক শাস্ত্রে কোল্হাসুর বধের কথা আছে। যদি কুবলয়পুর থেকে কোল্হাপুর শব্দটির উৎপত্তি হতো, তবে এই কাহিনীর সত্যতা থাকে না। শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রথম অধ্যায়ের কোলারাজ্যের রাজা সুরজের কথা বলা হয়েছে। কাশ্মীরের নিকটস্থ যবন (শক/কুষাণ) জাতি কোলাপুর আক্রমণ করায় তাদের কোলাবিধ্বংসী বলা হয়েছে।— 
তস্য পালয়তঃ সম্যক্ প্রজাঃ পুত্রানিবৌরসান্ ।
বভূবুঃ শত্রবো ভূপাঃ কোলাবিধ্বংসিনস্তদা ॥ ১.৫॥
তস্য তৈরভবদ্ যুদ্ধমতিপ্রবলদণ্ডিনঃ ।
ন্যূনৈরপি স তৈর্যুদ্ধে কোলাবিধ্বংসিভির্জিতঃ ॥ ১.৬॥
~ দেবীমাহাত্ম্য প্রথম অধ্যায় 
সুতরাং চণ্ডী অনুযায়ীও কোলাপুর নামটি সত্য। কুবলয়পুর এর তত্ত্ব সত্য হলে চণ্ডীর প্রামাণিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। প্রসঙ্গত, শংকর দিগ্বিজয় গ্রন্থেও চণ্ডীর উল্লেখ আছে। 
কুবলয়পুরের বর্তমান নাম কোলার যা কর্ণাটকে অবস্থিত । কুবলয়পুর থেকে কুবলাপুর এবং পরে কোলারপুর নাম হয়েছে। 

অপরাপর শাস্ত্রের প্রমাণ:— 

চণ্ডিকাদেবী

অরুন্ধদেষোऽমরমার্গমম্বিকে প্রজাতরোষঃ কনকাচলেন । বিন্ধ্যোऽপ্যয়ং শৈলবরস্ত্বদাশ্রযাত্পুণ্যং প্রতিষ্ঠানপুরং সুপুণ্যদম্ ॥৩৮ 
কোলাসুরেণাত্র সমীহিতা পুরী তপস্যতা তস্য বধাত্ত্বয়া জিতা । এষোऽরুণাদ্রিঃ প্রথিতপ্রভাবো বৃদ্ধাদ্রিরপ্যেব মমেষ্টবাসঃ ॥৩৯ 
~শিব রহস্য মহেতিহাস: প্রথম অংশ : অধ্যায় ২০

ওহে পার্বতি! অরুন্ধতীর তপের ফলে দেবমার্গ যেরূপ পূণ্যময় হয়েছে, তেমনই তোমার বসবাসের ফলে বিন্ধ্যাচল, প্রতিষ্ঠানপুর (অধুনা পাতিহান) ও তীর্থে পরিণত হয়েছে। 
কোলাসুর তথায় (প্রতিষ্ঠানপুরে) রাজধানী স্থাপন করেছিল, তুমি তাকে বধ করে বিজয়প্রাপ্ত করলে । তোমারই কৃপায় আমি অরুণাদ্রি প্রভৃতি স্থানে বাস করতে পারছি।  

বৈষ্ণবদের পরম প্রিয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ড অনুসারে (৫৮ থেকে ৬৬তম অধ্যায় ) দেবী মাহাত্ম্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে দেবী মাহাত্ম্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী গণেশজননী গৌরী স্বয়ং, সুরথ ও বৈশ্যের কথোপকথনে গিরিসুতার পূজার্চনা বিবৃত হয়েছে । 

সা ত্বং সতী ভগবতী বৈষ্ণবী চ সনাতনী। নারায়ণী বিষ্ণুমায়া মূলপ্রকৃতিরীশ্বরী ।মায়য়া মাং পৃচ্ছসি ত্বং সর্বজ্ঞা সর্বরূপিণী।। 
~ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ : প্রকৃতি খণ্ড : অধ্যায় ৫৪ : ১৭৮-১৭৯ 
ভগবান শিব দেবী পার্বতীর উদ্দেশ্যে বললেন, 
হে পার্বতি! তুমি সতী, ভগের অধিকারিণী ভগবতী, বিষ্ণুর স্থৈতিক শক্তি বৈষ্ণবী, সনাতনী। নারায়ণের পরিচালিকাশক্তি নারায়ণী, বিষ্ণুর অন্তস্থ যোগমায়ারূপিণী, মূলপ্রকৃতি ও ঈশ্বরী। হে হিমালয়কন্যা, যদিও তুমি সবকিছুই সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত, তবুও, জগতের কল্যাণের জন্য করুণাবশত, তুমি তোমার সর্বজ্ঞতাকে তোমার নিজের মায়া দিয়ে ঢেকে রাখো এবং আমার কাছে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করো, যদিও তুমি প্রকৃতপক্ষে সর্বজ্ঞ, সবকিছুর জ্ঞাতা। 
ত্রিপুরা রহস্যের মাহাত্ম্য খণ্ডে দত্তাত্রেয়কৃত গৌরী শতনাম স্তোত্রে পার্বতীদেবীকে শুম্ভনাশিনী বলা হয়েছে, 
অম্বা অম্বিকা অম্বুজধরা অম্বুরূপাঽঽপ্যায়িনী স্থিরা ।
শিবপ্রিয়া শিবাঙ্কস্থা শোভনা শুম্ভনাশিনী ॥ ১২॥ 
এর থেকে চণ্ডেশ্বরী যে পার্বতীই তা প্রমাণিত হয়। 
শাক্তাচার্য শ্রীপাদ নাগোজীভট্ট চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ে পার্বতীকৃত দেবতাদের জিজ্ঞাসা করার বিষয়ে বলেছেন, তাঁর জিজ্ঞাসা অজ্ঞতা থেকে জন্মগ্রহণ করেনি, বরং দেবতাদের উন্নীত করার জন্য তাঁর অসীম করুণা এবং ইচ্ছাকৃত ইচ্ছাশক্তি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। 
তথাপি তেষামজ্ঞানং দৃষ্টবা কা স্তূযত ইতি পৃচ্ছতি। সেতি। কা মদন্যা স্তূযতে যন্মাং নাভিভাষথ মদন্যাযা অভাবঃ। ততোऽপ্যজ্ঞানমেব দৃষ্টবা তেষাং দযযা স্বয়মব্রবীত্‌। 
~নাগোজীভট্টকৃত চণ্ডিকাভাষ্য: ৫:৩৮ 

শাক্তাচার্য শ্রীপাদ শান্তনু তাঁর চণ্ডীভাষ্যে বলেছেন, 
"সা ভগবতী পার্বত্যপি স্বাৎ শরীরকোশাৎ "
~ শান্তবী চণ্ডিকাভাষ্য : ৫.৪১ 
পার্বতীর দেহকোশজাতা (কৌশিকী) প্রকৃতপক্ষে পার্বতী স্বয়ং । 

শ্রীপাদ ভাষ্কররায়ের গুপ্তবতী টীকায় ভাষ্করাচার্য বলেছেন,
কালিকেত্যাখ্যাতা সতী হিমাচল এব নিখিলদেবপ্রর্থিতস্থানে তিষ্ঠতি। ন পুনঃ স্নানার্থং ততো নির্গত্য গতেত্যর্থঃ। দেবেষু স্তুবত্সু সত্সু তং স্তবমঙ্গীকৃতবত্যাঃ কৌশিক্যাস্তানুেক্ষ্যান্যত্র গমনস্যানুচিতত্বাদিতি ভাবঃ। 
চণ্ডীর গুপ্তবতী টীকা ৫:৪১
কালিকা (পার্বতী) নামে পরিচিত দেবী সেই স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন যেখানে সমস্ত দেবতারা তাঁকে আন্তরিকভাবে আহ্বান করেছিলেন (তন্ত্রোক্ত দেবীসূক্তের মাধ্যমে), তাঁদের অবস্থানে অবিচল থেকে। তিনি আর স্নানের উদ্দেশ্যে যান না, কারণ দেবতাদের উপেক্ষা করা অনুচিত হবে। 
অর্থাৎ দেবীসূক্তের অধিশ্বরী গৌরী নিজেই।  

স্কন্দপুরাণান্তর্গত ধর্মারণ্য খণ্ডে হিমবানতনয়া শান্তাদেবীকে মধুকৈটভনাশিনী বলা হয়েছে। অর্থাৎ দেবী গিরিসুতাই তামসীমূর্তিতে মহাকালী হন। 
তামসী সা মহারাজ মধুকৈটভনাশিনী ।
বিষ্ণুনা তত্র বৈ ন্যস্তা শিবপত্নী নৃপোত্তম ॥ ২ ॥
~ স্কন্দপুরাণ : ধর্মারণ্য খণ্ড : ১৭ অধ্যায় 

ততো জয়দ্রথযামলে— 
বিন্ধ্যে তু ভদ্রকালী ত্বং বিন্ধ্যাচলস্থিতা। 
নানারূপধরাদেবী ভক্তানুগ্রহকারিণী ॥ 
মহাকালী মহালক্ষ্মী মহাসরস্বতী তথা।
ত্রয়াণাং অপি রূপাণাং ত্বমেব পরমেশ্বরী ॥ 
এছাড়া, জয়দ্রথযামলের প্রথম ষটকের নবম পটলে বলা হয়েছে,
দক্ষস্য মখবিধ্বংশাদ্ একানংশাঽযুমা স্মৃতা ॥৩৫৯॥ 

ভদ্রকালীতি চান্যাসৌ নাম প্রাপ্তা তনুদ্বয়া । অস্মিন্ চতুর্যুগে কৃষ্ণসহিতা কৃষ্ণপিঙ্গলা ॥৩৬০॥ 

অবধীর্মাহিষং তেন দুর্গাসৌ বিন্ধ্যবাসিনী । ভক্তানাং অনুকম্পার্থং অবতীর্য সুমধ্যমা ॥ ৩৬১॥ 
দক্ষকন্যা উমা একানংশা দেহত্যাগের পরে মহিষবধের নিমিত্ত দুর্গা বিন্ধ্যাচলনিবাসিনী রূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। তিনিই মহালক্ষ্মী,মহাকালী ও মহাসরস্বতী স্বরূপিণী। 

হরিবংশ পুরাণে বলা হয়েছে, 
নমঃ শত্রুবিনাশিন্যৈ নমো গৌর্যৈ শিবপ্রিয়ে ।
নমস্যে শুম্ভমথনীং নিশুম্ভমথনীমপি ॥ ৭ ॥ 
হরিবংশপুরাণ : বিষ্ণুপর্ব: অধ্যায় ১০৭ 
বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের হরিবংশপুরাণ অনুযায়ীও শিবপ্রিয়া গৌরী শুম্ভ ও নিশুম্ভদৈত্যের হত্যাকারী মহাসরস্বতী।  

তদন্কমণ্ডলারূঢা শক্তির্মাহেশ্বরী পরা। মহালক্ষ্মীরিতি খ্যাতা শ্যামা সর্বমনোহরা ॥২৩
~ শিব মহাপুরাণ: বায়ব্য সংহিতা : উত্তরভাগ: অধ্যায় ৩২ 
শক্তিদেবী মহেশ্বরের অঙ্কে স্থিত হয়ে মাহেশ্বরী হন । শ্যামাদেবী মহালক্ষ্মী ও সৌম্য হয়ে সকলের মনকে আকৃষ্ট করেন। 

মহালক্ষ্মীর্জগন্মাতা কালিকা মেনকাত্মজা (৪) নানারূপধরা সৈবমবতীর্য়ৈব পার্বতী (৫) 
~ সৌরপুরাণ : উত্তরসংহিতা: অধ্যায় ৪৯ 
 
মহালক্ষ্মীদেবী জগতের মাতা, তিনি মেনকাদেবীর কন্যা, দেবী নানান স্বরূপ ধারণ করেন । তিনিই পর্বতরাজকন্যা পার্বতী।  

কবি শ্রীনারায়ণভট্টারী দুর্গা সপ্তশতীর সম্পর্কে নিম্নোক্ত শ্লোক রচনা করেছেন, 
ত্বৎপাদোঽযমজাশ্রিতশ্চ রুচিরস্পর্শান্বিতো যোগিনা-মন্তঃস্থাকৃতিরুষ্মভাক্ চ মহিষপ্রধ্বংসনপ্রক্রমে । এবং খল্বখিলাক্ষরাত্মকমমুং শৈলেন্দ্রকন্যে কথং ভাষন্তে নতবর্গবন্ধুমপবর্গালম্বনং বা জনাঃ ॥ 
হে শৈলেন্দ্রকন্যে! তোমার পদযুগল ব্রহ্মদেবের ত্রাতা,  এই অতিকোমল আঙ্ঘ্রিকদ্বয় যোগীগণের হৃৎপদ্মে সর্বদা স্থিত, এই চরণযুগলই মহিষাসুর বধের সময় ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে, ভুক্তিমুক্তিদায়ক এই পাদাব্জদ্বয়ের বর্ণনা আর কিভাবে করবো ? 
এছাড়াও তিনি বলেছেন, 
ত্বং শম্ভোর্মহিষী ভবস্যগসুতে তেনোপহাসায় তে দৈত্যোঽযং মহিষীভবন্নুপগতঃ সোঽযং কথং ক্ষম্যতে ।
ইত্থং নূপুরনিস্বনৈরিব বদন্ পাদ স্ত্ত্বদীযো রুষা শস্ত্রপ্রগ্রহণাত্ পুরৈব মহিষং পিষ্ণন্ পরিত্রায়তাম্ ॥ ৫০ ॥
বারংবার মেলপাত্তুর নারায়ণ ভট্টারি শম্ভোর্মহিষী বলে উল্লেখ করেছেন । 

আচার্যপ্রবরদের মধ্যে অয়প্প দীক্ষিতর্, গণপতি মুনি, নারায়ণ গুরু, গোস্বামী তুলসীদাস, শিখ সম্প্রদায়ের গুরু গোবিন্দ সিং সকলেই মহিষাসুরমর্দিনী বলতে হিমালয়রাজকন্যা উমাকে বুঝিয়েছেন।  কবিদের মধ্যে মহাকবি কালিদাস, বাণভট্ট, কবি সোমরাজ, অভিরামী পট্টর্, শ্যামশাস্ত্রী প্রমুখও একই কথা বলেছেন। 
বাণভট্টের চণ্ডী শতকম্
রুদ্রযামলের পরাদেবীরহস্যতন্ত্র বা দেবীরহস্যে বলা হয়েছে, 
রাত্রিসূক্তং জপেদাদৌ মধ্যে শক্রকৃতস্তবম্। 
নারায়ণীস্তুতিং পঠেদন্তে গিরিজাপ্রীতিকরম্॥ 
রাত্রিসূক্ত, শক্রাদিকৃতস্তব, নারায়ণী স্তুতি পাঠ করে গিরিজাকে প্রসন্ন করা উচিত। 

শুধু তাইই নয়, রুদ্রযামলাগম এর আনন্দেশ্বর তন্ত্রের পার্বতীদেবীর যজ্ঞবিধিতে দেবীকে অষ্টাদশভুজা, মহিষমর্দিনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 
আনন্দেশ্বর তন্ত্রের পাণ্ডুলিপি


অন্নপূর্ণাদেবীকে তাঁর উপনিষদে মহালক্ষ্মী বলা হয়েছে, 
নিত্যানন্দা নিরাধারা বিখ্যাতা বিলসৎকচা। বিষ্টপেশী মহালক্ষ্মীঃ কামস্তারো নতিস্তথা ॥ 
~ অন্নপূর্ণা উপনিষদ 

কালরাত্রিং ব্রহ্মস্তুতাং বৈষ্ণবীং স্কন্দমাতরম্ । মহালক্ষ্মীশ্চ বিদ্মহে সর্বসিদ্ধিশ্চ ধীমহি তন্নো দেবী প্রচোদযাত্ ॥ এষা বিশ্বমোহিনী পাশা‌ঙ্কুশধনুর্বাণধরা। এষা শ্রীমহাবিদ্যা ॥  
~ দেবী উপনিষদ 
কালরাত্রিদেবী ব্রহ্মার দ্বারা স্তুতা হন, তিনি বিষ্ণুর শক্তি ও কার্তিকের মাতা।  সেই মহালক্ষ্মীকে স্মরণ করি যিনি সর্বসিদ্ধি প্রদান করেন । সেই দেবী আমাদের ধী বা বুদ্ধি প্রদান করুন। বিশ্বকে মোহিতকারিণী দেবী পাশ,অঙ্কুশ, ধনুক ও বাণ ধারণ করেন। তিনি মহাবিদ্যা।  

হংসষোঢ়পনিষদে বলা হয়েছে, 
"মহালক্ষ্মি রাজরাজেশ্বরি মহাকালপ্রিয়ে কালখণ্ডিনি "

ত্রিপুরা তাপিনী উপনিষদেও ললিতা মহাত্রিনুরসুন্দরীকে মহালক্ষ্মী বলা হয়েছে — 
মহানিত্যোপস্থিতাং পাশাঙ্কুশমনোজ্ঞ পাণিপল্লবাং সমুদ্যদর্কনিভাং ত্রিনেত্রাম্ । বিচিন্ত্য দেবীং মহালক্ষ্মীং সর্বলক্ষ্মীময়ীং সর্বলক্ষণসম্পন্নাং হৃদযে চৈতন্যরূপিণীম্ । নিরঞ্জনাং ত্রিকূটাখ্যাং স্মিতমুখীং সুন্দরীং মহামায়াম্ ॥  

করবীরাসুর বধ — 
কোল্হাসুরের পুত্র করবীরাসুর কে ভগবান শিব বধ করেন। তাই করবীরপুরে মহালক্ষ্মী র পরেই প্রধান দেবতা হলেন পরমশিব । শিলালেখতে বলা হয়েছে, 
কমলভবকরোটিব্রাতমালাধরত্বাৎ তদধিকবলশালী ভাসি কঙ্কালনাথঃ । 
পরশিব করবীরক্ষেত্রমধ্যস্থলিঙ্গে নিবসসি সুরবন্দ্যো নামতস্ত্বং কপালী ॥ 

বারাণসীতে কপালমোচন করে, সেই কপাল তিনি এখানে সমাধিস্থ করেছিলেন, 
কপালং স্থাপিতং যত্র করবীরস্য ধীমতঃ । কপালসংজ্ঞকং তীর্থং কপালীশ্বরসন্নিধৌ ॥ 

গিরিজাদেবী কোল্হাসুর ও শিব করবীরাসুর কে বধ করেন, নীচের শ্লোক দ্বারাই প্রতিপাদিত হয়ে যায়, 
রুদ্রাদিভির্হতৌ যত্র পিতাপুত্রৌ মহাসুরৌ । 
কোলাসুরো মহাবাহুঃ করবীরস্তু তৎসুতঃ ॥ 
ঐতত্সংজ্ঞাভিধং ক্ষেত্রং অবিমুক্তপুরং সতি । 
কোলাপুরমিতি খ্যাতং করবীরমিতীরিতম্ ॥ 
পরিশেষে, গোস্বামী তুলসীদাস জিউর ভবনের মাধ্যমে আজকের লেখাটি সম্পূর্ণ করবো। তিনি দেবীমাহাত্ম্য এর সারাংশ নিংড়ে উক্ত ভজনটি রচনা করেছিলেন, 
জয় জয় গিরিবররাজকিশোরী ।
জয় মহেশমুখচন্দচকোরী॥
জয় গজবদন ষডাননমাতা ।
জগত জননী দামিনী দুতি গাতা॥

Comments

Popular posts from this blog

Oḍiyāna Mahāpīṭha

Durga Krama : A Short Description

Who is the main deity of Durga Kula? Is it Ashtabhuja Durgambika or Chaturbhuja Jagadhatri?