পার্বতী — পর্বতকন্যা, অবহেলিতা, বারবার আক্রমণের লক্ষ্য — রক্ষিত হন কদাচিৎ
পার্বতী — পর্বতকন্যা, অবহেলিতা, বারবার আক্রমণের লক্ষ্য — রক্ষিত হন কদাচিৎ
পোস্ট ক্রেডিট: নিহাল ঠাকুর (Quora)
মূল লিংক: ক্লিক করুন
ডিজিটাল জগতে, যেখানে নানা মত, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সংঘর্ষ ঘটে, সেখানেই আজ দেবী পার্বতী একটি নীরব কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছেন। যাঁর গুরুত্ব সনাতন ধর্মে অপরিসীম, তাঁকেই আজকের ইন্টারনেট পরিসরে অদ্ভুতভাবে অবহেলা ও কটাক্ষের শিকার হতে দেখা যায় — এবং দুর্ভাগ্যবশত, এই বিষয়গুলো প্রায় কখনোই আলোচিত হয় না।
অন্যান্য দেবতাদের বিরুদ্ধেও সমালোচনা হয়, কিন্তু পার্বতীকে ঘিরে বিদ্বেষ সাধারণত সুকৌশলে ঢেকে রাখা হয় — কখনো মিম, কখনো কটাক্ষাত্মক মন্তব্য, আবার কখনো বিকৃত ব্যাখ্যার আড়ালে। তাঁকে কখনো “যজ্ঞ-ভক্ষণকারিণী,” কখনো “অসম্পূর্ণ অর্ধাংশ,” আবার কখনো “শাক্তধর্মের অযোগ্য” বলে কুৎসা রটানো হয়। অথচ এই বিদ্বেষের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো — এই বিষয়ের প্রতি সকলের নিস্পৃহতা, নীরবতা।
কারও কারও মতে, এটি অন্য দেবীর প্রতি ভক্তির প্রকাশ — যেমন বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মীর। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যায়, এ যেন পার্বতীর মর্যাদাকে হ্রাস করার অজুহাত মাত্র।
ভক্তি মানে তো অন্য একজনকে অপমান করা নয়।
দেবী পার্বতী সেই শক্তি, যিনি দেব-অসুর সকলকে গ্রাস করতে পারেন —কপালহস্তা বিকটা ভক্ষযন্তী সুরাসুরান্ ।
নৃত্যন্তী চ হসন্তী চ বিপরীতা মহারবা ॥ ১১ ॥ (স্কন্দপুরাণ ৫.৩.১৫.১১)।
সেই পার্বতীকে নিয়ে কটাক্ষ করা মানে ঈশ্বরত্বকে অস্বীকার করা।
আজকের দিনে, ধর্মীয় অবমাননার পরিণামে অনেক দেবতার জন্য প্রতিবাদ হয়, পোস্ট হয়, আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু যখন পার্বতীকে অপমান করা হয় — “Bhaunkti” (ঘেউ ঘেউ করা), “চুলের চেয়েও কম”, “রণ্ডি” ইত্যাদি গালিগালাজ ব্যবহার করে — তখন সমাজ চুপ থাকে। এই নীরবতা অন্যায়ের সঙ্গে সহমত প্রকাশের শামিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।"
পার্বতী — যিনি ব্রহ্মারও আগে পূর্ণব্রহ্ম বলে স্বীকৃত, যাঁর পদতলে ইন্দ্রাণী, সরস্বতী, লক্ষ্মী, স্বাহা সেবা করেন, যাঁর রূপ লজ্জায় ফেলে মেঘকেও (স্কন্দপুরাণ ১.৩.১২.৫২) — তাঁকেই অপমান করে কিছু লোক।
দেবী সরস্বতী বা লক্ষ্মীর নামে যাঁরা নিজেদের ভক্ত দাবি করেন, তাঁরাই আজ পার্বতীর নামে নোংরা শব্দ ব্যবহারে পিছপা নন। কেউ কেউ ফেক শ্লোক বানিয়ে প্রমাণ করতে চায় পার্বতী নাকি ছোট!
“জাম্ববতী” বা “ভারতী” হয়ে যাওয়ার গল্প — এসব ভুল পুরাণ ব্যাখ্যার ফাঁদে মানুষ পড়ে। অথচ সত্য এই যে, পার্বতীই পূর্ণব্রহ্ম — “ব্রহ্মবাহমিতি স্ফুটম্” (শিবপুরাণ ৫.৪৯.২৩)।
লোক হাসে, মজা করে, নীরব থাকে — কারণ এটা “অন্য দেবীর ভক্তি” হিসেবে প্যাকেজ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো — ভক্তি কি অপমানের ছায়া নিয়ে আসে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শাক্ত সম্প্রদায়ের ভেতরেও পার্বতীকে নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এর কারণ, কিছু মায়াবাদী/শংকরবাদী "শাক্ত" ছদ্মবেশ ধারণ করে শাক্তধর্মকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন নকল শ্লোক, নকল গ্রন্থ বানিয়ে, এমনকি মহাবিদ্যা কর্তৃক গিরিজাকে খাদ্য হিসাবে দেখিয়ে, নকল দেবীদেবতা তৈরী করে এরা উপনিবেশ বিস্তার করতে চাইছে। কেউ বলেন, তিনি শাক্তধর্মের “মূল” নন — অথচ দেবী ভাগবত পুরাণ (১২.৮.৪৭)-এ তিনি নিজেই বলেন:
"সা চ মায়া পরা শক্তিঃ শক্তিমত্যহমীশ্বরী।"
তিনি কুলধর্মের স্বামিনী কুলেশ্বরী। অথচ কিছুজন তাঁকে শাক্তধর্ম থেকে বাদ দেওয়ার অপপ্রয়াস চালায়।
ঊর্ধ্বাম্নায় তন্ত্রে তাঁকে সকল কুলের ঈশ্বরী বলেছে।
আরও বিস্ময়কর: কেউ কেউ বলেন তিনি “অর্ধমৃত”! — অথচ স্কন্দপুরাণ (৫.৩.১৪.৪৯) বলে:
সা চ দেবী দিশঃ সর্বা ব্যাপ্য মৃত্যুরিব স্থিতা ।
যুগক্ষযকরে কালে দেবেন বিনিযোজিতা ॥ ৪৯ ॥
“সর্বব্যাপী মৃত্যু রূপে বিরাজমান তিনি।”
তাঁকে “রণ্ডি” বলা হয় — অথচ তিনি বেদের জননী, গায়ত্রী, সর্বজ্ঞা।
ত্বং দেবি বেদজননী প্রণবস্বরূপা গাযত্র্যসি ত্বমসি বৈ দ্বিজকামধেনুঃ ।
ত্বং ব্যাহৃতিত্রযমিহাঽখিলকর্মসিদ্ধ্যৈ স্বাহাস্বধাসি সুমনঃ পিতৃতৃপ্তিহেতুঃ ॥ ৬১ ॥
(স্কন্দপুরাণ ৪.১.৪৯.৬১)
বৈষ্ণবদের একাংশ সুকৌশলে প্রথমে প্রচার করছিল, ভগবতী লক্ষ্মীকে যে অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, ভগবতী পার্বতীকে তার একাংশও সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ভগবতী পার্বতীর মত অন্য কোনো দেবতাকেই "রণ্ডী", "বেশ্যা", "হিজরা", প্রভৃতি শব্দ দিয়ে অপমান করা হয়নি । মাতা কামাখ্যাকে বহু তথাকথিত বৈষ্ণব ও মায়াবাদীরা কটাক্ষ করেছিলেন তাঁর "যোনীপূজা" র জন্য। বৈষ্ণব ও মায়াবাদীদের সঙ্গে শাক্ত ও শৈবদের সংঘাত কি বাস্তবে আর্য অনার্য সংঘর্ষের বিবর্তিত রূপ কিনা ভেবে দেখা উচিত। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান দুই গুটি বৈষ্ণবধর্ম ও মায়াবাদ হাজার হাজার বছর ধরে অনার্য ভাবধারাকে লুপ্ত করার চেষ্টা করে এসেছে, যাতে নিম্নবর্ণের সকল প্রকার অধিকার লোপ পায়। Facebook এর মত social media platform এ লক্ষ্মীবাদী বৈষ্ণবরা সুকৌশলে প্রথমে লক্ষ্মী পার্বতী একাত্ম করে পরে ধীরে ধীরে গিরিজা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সবচেয়ে হাস্যকর হল এই ব্যাপারটা, যে বৈষ্ণবেরা এতদিন গৌরী মহিমাব্যঞ্জক মার্কণ্ডেয় পুরাণকে "তামসিক" বলে প্রচার করছিল, তাঁরাই এখন দুর্গা সপ্তশতী বা শ্রীশ্রীচণ্ডীকে লক্ষ্মী মাহাত্ম্যের গ্রন্থ বলে প্রচার করছে। বস্তুতঃ, পরস্পরের প্রতি হিংসা র প্রথম উৎপত্তি ঘটেছিল বৈষ্ণবদের সত্ত্বেও,রজঃ, তমঃ গুণানুসারে পুরাণ বিভাজনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অনার্য ও হরপ্পীয় সংস্কৃতি যে তথাকথিত সভ্য আর্যদের কাছে বরাবরই "তামসিক" বা "অসভ্য" ছিল।
এত অপমানের পরও প্রতিক্রিয়া কোথায়?
যখন অন্য দেবতারা আক্রমণের শিকার হন, তখন প্রতিবাদ হয়। কিন্তু পার্বতীর অপমানে শোক বা প্রতিবাদ খুবই কম। এমনকি তাঁর ভক্তরাও অনেক সময় চুপ থাকেন — “বিতর্ক হবে” ভেবে।
কিন্তু এই চুপচাপ থাকার সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে আরো দুর্বল করে।
প্রেম মানে অন্যকে ঘৃণা নয়।
ভক্তি মানে উপহাস নয়।
নীরবতা মানে সম্মতি।
আমরা পার্বতীকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। তাঁর পদপদ্মে শরণ নেওয়াকেই আনন্দ মনে করি। যদি এর জন্য একা পড়তে হয়, তাও আমরা এই অপমান সহ্য করব না।
Comments
Post a Comment